১. আমি তখন একাদশ শ্রেণী।
নটরডেমকলেজে পড়ি। বাবার সাথে নদীপথে লঞ্চে ঢাকায় আসা-যাওয়া করি। সে সময় শরীয়তপুর থেকে ঢাকার বাস চালু হয় নি। প্রমত্তা পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিয়েই বাড়ি থেকে ঢাকায় আসতে হয়।আমি লঞ্চে ঘুমাতে পারি না। কিন্তু আমার বাবা লঞ্চে ঘুমানোর অসীম ক্ষমতার অধিকারী।লঞ্চ স্টার্ট করে মাত্র দুইশো মিটার না যেতেই বাবার নাক ডাকা শুরু হয়ে যায়।একেবারে লঞ্চের ইঞ্জিনের সাথে সুরে সুরে। আর এটা নিয়ে আমার কিশোর মনে চলতে থাকতোকত ভাবনা, কত না দুর্ভাবনা।
হয়তো কোন একদিন লঞ্চের ডেকে বসে আছি। পাশের বিছানায় আমারই বয়সী একটা টুকটুকে মেয়ে। মাঝে মাঝে মেয়েটার সাথে এক-আধটু চোখাচোখি হচ্ছে।বেশ লাগছে। মাথার মধ্যে হালকা করে ভ্রমর গুনগুন করতে শুরু করেছে। এভাবেই বুঝি শুরু হয়! এমন সময় বাবা শুরু করলো নাক ডাকা। ছি! এই সময় বাবা নাক ডাকার মত এমন একটা গর্হিত কাজ করতে পারলো? মেয়েটা আমাকে কি ভাবছে? প্রেস্টিজ আর কিচ্ছু থাকলো না। হলো না। বাবাটাকে আর পাল্টানো গেলো না। তবে যখন বাবা লঞ্চের কেবিন ভাড়া করতেন, তখন আর এই সমস্যা নেই। কেবিনে শুয়ে বাবা যতই নাক ডাকুক, কোন তরুণীর কাছে আমার প্রেস্টিজ মাটি হবার সম্ভাবনা নেই।
তো একবার কেবিনেই বাড়ি যাচ্ছি। যথারীতি আমি আর বাবা। কেবিনটায় আলো একেবারেই নেই। অতি ছোট্ট একটা টিউব লাইট। আমি তখন যেখানেই যেতাম, হাতে থাকত বই। সেদিন ঐ আলোতেই বই খুলে বসলাম। বাবা বললেন– ‘এই আলোতে বই পড়া যাবে না। এমনিতেই তুমি চশমা পরো, চোখের বারোটা বাজবে – বই বন্ধ।’ এই বয়সটাতেই ছেলেরা প্রথম বাবাকে তাদের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। বাবাই যেন তার সব কিছুর বাধা। কেন বাবা তাকে সব কিছুতে বাধা দেন? কেন সে যা করতে চায় বাবা সব সময় তার উল্টোটা করতে বলেন? বাবাই তার স্বাধীনতার পথের কাঁটা। তবু মেনে নিতে হয়। আমিও মেনে নিলাম। বই বন্ধ করলাম। একটু পরে বাবার চোখ বুজে গেলো।ভাবলাম – বাঁচা গেলো। আবার বইটা খুলে বসলাম।
মিটমিট করে চোখের একেবারে সামনে নিয়ে বই পড়ছি। হঠাৎ বইটাতে একটা টান। আমার তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। বাবার কুম্ভকর্ণ ঘুম যে এখন ভাঙতে পারে, তা আমি কল্পনাও করি নি। বাবা কিন্তু কিচ্ছু বললেন না। ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট টর্চ বের করলেন। আমার বইয়ের উপর টর্চের আলো ফেলে বললেন, এইবার পড়। তিনি আলো ধরে আছেন-আমি পড়ছি। কি যন্ত্রণা! যেই লোকটার এতক্ষণে নাক ডাকার কথা, তিনি সেটা না করে আমার বইয়ের উপর টর্চ ধরে বসে আছেন। আমি বললাম, টর্চটা আমাকে দিয়ে তুমি ঘুমাও। তিনি দিলেন না। আসলে বাবা জানতেন, একটু পরেই আমি বই খুলে বসব। তাই তিনি আসলে ঘুমান নি। ঘুমানোর ভান করেছিলেন।
তখন বুঝিনি– পৃথিবীর সকল সন্তানকেই তার নিজের চেয়ে পিতাই অনেক বেশি চিনেন। আমার আমি তো কৈশোর পার হবার পরের আমি। কিন্তু বাবার আমি আমার প্রথম চিৎকারের আমি। প্রথম হাঁটতে শিখার আমি। প্রথম কথা বলার আমি। আমার প্রথম মিথ্যে বলার সাক্ষী তিনি। তিনিই আমার প্রথম ভুল ধরে ফেলা পুলিশ। আমাকে শাস্তি দেয়া প্রথম বিচারক। আমাকে ভালো মানুষ করার প্রথম গুরু। বাবাই আমাদের প্রথম আইডল।
যাই হোক এক সময় আমি আর বাবা দুজনেই ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু আমি তো লঞ্চে ঘুমাতে পারি না।একটু পরে ঘুম ভেঙে গেল। আবার বই বের করলাম। টর্চের আলোতে পড়ছি স্টিফেন হকিং-এর‘ব্রিফহিস্ট্রি অফ টাইম’। হকিং সাহেব শুরু করেছেন -A well-known scientist (some say it was Bertrand Russell) once gave a public lecture on astronomy …. বিখ্যাত বিজ্ঞানী লেকচার দিচ্ছেন – পৃথিবীগোল, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। পেছন থেকে একবৃদ্ধা উঠে বললো, যত্তো সব রাবিশ কথাবার্তা! পৃথিবী তো ফ্লাট – একটা বড় কচ্ছপের পিঠে বসে আছে। বিজ্ঞানী বললো, বেশ তাই সই – তাহলে কচ্ছপটা কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে? বৃদ্ধারাগ করে শাসিয়ে উঠলো, আমার সাথে চালাকি করো না– সবার নিচে তো কচ্ছপটাই আছে– তার নিচে আবার কি আছে? আমি পড়ছি আর হাসছি। ভাবছি আজ রাতেই পুরো‘ব্রিফহিস্ট্রি অফ টাইম’ বইটা শেষ করে ফেলব – যদি ততক্ষণ টর্চের আলোটা থাকে।
হঠাৎ লঞ্চটা একটু জোরে দুলে ওঠলো। সময়ের সাথে সেই দুলুনি একটু একটু করে বাড়ছে। বাবার ঘুম ভেঙে গেলো। বাবা বুঝতে পারলেন নদীতে ঝড় উঠছে।তিনি লাফ দিয়ে কেবিনের দরজা খুলে ফেললেন। আমাকে বললেন, ফুলপ্যান্ট খুলে ফেল, শর্টস পড়ে নে। আমি তাই করলাম। একটু পরআবার বললেন, জামা খুলে ফেল। লঞ্চ ডুবে গেলে সাঁতার দিতে হবে– গায়ে কিচ্ছু রাখার দরকার নেই– একেবারে হালকা হয়ে নে। কিন্তু আমি দেখলাম, বাবা এখনও ফুলপ্যান্ট পরে আছেন– সাথে মাফলারও আছে। আমার গায়ের সব কিছু খুলে আমাকে একেবারে হাল্কা করছেন। কিন্তু নিজে যে সবকিছু পরে আছেন– সেটা তাঁর মনেই নেই।লঞ্চের দুলুনি আরও বাড়ছে। মাঝে মাঝেএকদিকে অনেকটা কাত হয়ে যাচ্ছে। বাবার চোখ উদভ্রান্ত। আমার দিকে তাকাচ্ছেন আর ভাবছেন আমার জন্য আর কি করা যায়?
হঠাৎতাঁর মনে হলো, আরে লঞ্চে তো বয়া আছে – বয়া ধরে তো পানিতেভেসে থাকা যায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। সবগুলো বয়া দখল হয়ে গেছে।কিন্তু বাবার তো লাগবেই – অন্তত একটা বয়ায় আমার জন্য এক ফোঁটা জায়গা তাকে করতেই হবে। বাবা ছুটছেন পাগলের মত। এদিক থেকে ওদিক। আমি কিছুতেই তাকে থামাতে পারছি না।লঞ্চটা একেক দিকে হেলে পড়ছে। তার মধ্যেই বাবা ছুটছেন। কিন্তু প্রতিটা বয়ার চারপাশে অনেক লোক। বাবা সামনে যেতেই পারছেন না। আমি শুনছি তিনি কাকে যেন বলছেন– ‘ভাই, আমার কিচ্ছু লাগব না, তুমি এই ছেলেটারে বয়াটা একটু ধরতে দিও।’
আমার বুক ফেটে কান্না আসছিলো। একটু পরে লঞ্চ ডুবে গেলে আমি মারা যাব – সেটা আমার মনেই হচ্ছিলো না। শুধু কান্না আসছিল বাবাকে দেখে। আমাকে বাঁচাতে – শুধু আমাকেই বাঁচাতে – তিনি নিজেকে তুচ্ছ করে যেভাবে ছুটছেন– সেটা দেখে আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছিল।
অতি বড় দুঃসময় নাকি হঠাৎ করেই কেটে যায়। সেই রাতের ঝড়টাও যেন একসময় হঠাৎ করেই থেমেগেলো। কিন্তু সেই রাত আমাকে অনেক বড় করে তুললো – আমার বয়স অনেকটা বাড়িয়ে দিলো।আমি বুঝতে শিখলাম– আমার কিশোর বয়সের বাবা আমার প্রতিপক্ষ নয়। তিনিই আমার কচি বয়সের আশ্রয়, আমাকে সঠিক লাইনে রাখার কম্পাস। আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আমাকে বাঁচাতে চায়, এমন মানুষ পৃথিবীতে মা-বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। আমার মনে হলো– বাবার নাক ডাকার শব্দের চেয়ে পবিত্র শব্দ আমার জন্য আর নেই।
আমি এখন দেশ বিদেশে ঘুরি। মায়ের সাথেই ফোনে কথা বলি। বাবাকে দরকার ছাড়া ফোনও দেয়া হয়না। বাবার নাক ডাকার মতো অতো পবিত্র শব্দ আমি কতদিন শুনি না। তবু আমি জানি – আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়টা আমার জন্য তাঁর ছায়া বিছিয়ে বসে আছেন বাংলাদেশের ছোট্ট এক গ্রামে। আমি অনেক ভাগ্যবান যে– আমার একজন বাবা আছেন।
২। আমার তখন দুধ দাঁতের বয়স।
কৃষ্ণপক্ষের সন্ধ্যাগুলোতে ঠাকুরমা পুকুরের কোণে চাটাইয়ে শুয়ে রূপ কথা বুনতেন। রূপকথায় চরিত্র হয়ে নেমে আসত মাথার ওপরের সপ্তর্ষি, ধ্রুবতারা আর কালপুরুষরা।গল্পে ভেসে ভেসে এরা আমার খেলার সাথী হয়ে উঠল।
কিছুদিন পরে ঠাকুরমার কাহিনীতে সপ্তর্ষির বশিষ্ঠ, পুলস্ত্যদের জায়গায় বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথরা চলে এলেন। তখন সূর্য ডুবলেই আমার আকাশে সন্ধ্যা তারা হয়ে ভেসে উঠতেন বিদ্যাসাগর। নিজেকে ভাবতাম এক দরিদ্র, মাতৃভক্ত বালক বিদ্যাসাগর, যে কিনা অতি অল্প বয়সেই দুনিয়ার সকল বিদ্যা আয়ত্ত্বে এনে, অনেক টাকা পয়সা উপার্জন করে সমাজের জন্য, শিক্ষার জন্য সব অকাতরে বিলিয়ে দেবে। এমন খেলা করতে করতে দিনেদিনে আকাশ হয়ে উঠল‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’।ঠাকুরমা গল্প শেষে প্রায়ই বলতেন– আকাশের মতো বিশাল হতে হবে। বলতে বলতে তিনি নিজেই একদিন আকাশের শুকতারা হয়ে গেলেন।আর বিদ্যাসাগরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্বর্গের বিধবাদের বিবাহ দিতে। আমার নিজের জন্য রইল শুধুই আকাশ – শৈশবের প্রত্যেকটা অভিযোগ জমা রাখার নিজস্ব ডেটাবেজ, প্রত্যেকটা আনন্দ শেয়ার করার সাতরঙা মনিটর।আসলে আকাশই ছিল আমার শৈশবের ফেইসবুক।
স্কুল পাশ করে যেদিন লঞ্চে করে ঢাকায় আসছিলাম, পদ্মায় ধুয়ে যাচ্ছিল আমার শৈশব– ভেসে যাচ্ছিল শৈশবকে ছুঁয়ে থাকা আকাশ।ঢাকায় এসে ওই আকাশটাকে আমি আর পাইনি। উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁক দিয়েও পরে তাকালে যা দেখতাম, তাকে আর নিজের মনে হতোনা।
নটরডেম কলেজ শেষ হলে গ্রাজুয়েশনের জন্য আমাকে টেনে নিল সিলেট।সেশন জ্যাম, ঝুলে থাকা ভবিষ্যত, চিঠিতে করে বাবার ফাঁকা পকেটে ইঁদুর চালান দেওয়া মিলিয়ে সময়টা ছিল বিবর্ণ – একেবারে বাংলাদেশের গতানুগতিক স্নাতক শ্রেণীর ছাত্রের মতোই। সেই বিবর্ণ সময়ে মুচকি হেসে চোখ টিপে হাজির হয়েছিল আমার শৈশবের আকাশটা।
সারাদিন ইলশে গুড়ি বৃষ্টি নিয়ে সিলেটের আকাশ কিছু না বলেই রঙ বদলায়।মেঘ খুবই ঘনঘন দুগ্ধবতী হয়, আর আকাশও সারাদিনই একটু একটু করে নামতে থাকে প্যারাস্যুট বেয়ে।এই নেমে আসা মেঘের দুধে আমার কষ্ট ভিজে তুলোর মতো হয়ে যেত, ব্যথা লাগতো না। আবার মাঝে মাঝে মেঘ বিদায় নিলে মেঘালয়ের ঝকঝকে শিলঙ পাহাড়ের সারি রবিঠাকুরের লাবণ্যের আঁচলের মতো ভেসে উঠত উত্তর আকাশে। চারতলারও পরে মেসের বারান্দা থেকে একেবারে ঝকঝক করতো শিলং।আমি তখন অমিত রায়, আমার বারান্দা ‘শেষেরকবিতা’- চোখের সামনে লাবণ্য হাঁটছে শিলঙের ঝকঝকে চুড়া বেয়ে।আকাশ বলছে, ‘For God’s sake hold your tongue and let me love’. আমি যেন সেই দেড়শো বছরের বুড়োর মতই কাকে যেন শোনাচ্ছি– ‘ছাদের উপরে বহিয়ো নীরবে– ওগো দক্ষিণ-হাওয়া প্রেয়সীর সাথে যে নিমেষে হবে চারিচক্ষুতে চাওয়া’ আকাশের সাথে এমন প্রেম প্রেম খেলতে খেলতে একদিন সিলেট থেকে চলে আসলাম। ঢাকায় এসে ওপরের দিকে তাকালেই মনে হতো– ‘তুমি আর নেই সে তুমি!’ বেকারত্ব, চাকরি, সংসার কত কিছু মিলে আকাশের অভাবও আর বিশেষ মনে ছিলনা।
অনেকদিন পরে বুড়ো বয়সে আবার পড়াশোনা করতে সাধ হল। আসলাম অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা শহরে। এখানে এসে আবার ফিরে পেলাম সেই অসীম গগনকে– আমার শৈশবের ফেইসবুককে। শৈশবের মতোই রাতের আকাশে খুঁজতে শুরু করলাম সপ্তর্ষিমণ্ডলকে। অনেকদিন খুঁজে চলেছি– মনে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে একরাতে অস্ট্রেলীয় ফিল্ম আর্কাইভের সামনে দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে হাঁটছি। হঠাৎ এক বৃদ্ধা জানতে চাইলেন, কী খুঁজছি? শুনে বললেন, ‘আহা, বোকাছেলে, অস্ট্রেলিয়া তো পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে। আর দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশে সপ্তর্ষি দেখা যায়না।’ একেবারে পরিষ্কার বোল্ড। কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমিতো ছোটবেলা থেকেই একধরনের বোকা। বোকাদের এত কিছু জানতে হয়না!
ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা দূর করে হাসিমুখে বৃদ্ধাকে বললাম, ‘তুমি সপ্তর্ষি দেখেছ?’
– ‘দেখেছি, প্রশ্নচিহ্নের মতো।শ্রীলংকা গিয়েছিলাম অনেকদিন আগে।’
– ‘এরকম সুন্দর একটা জিনিসকে তোমরা ইংরেজিতে‘গ্রেট বেয়ার’ মানে ভল্লুক নাম দিলে?’
– ‘হুম, এখানেই তোমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দর্শন, সংস্কৃতির সাথে আমাদের পার্থক্য।আমি জানি, তোমরা ওই তারকামণ্ডলীকে সাতজন ঋষির নাম দিয়েছ। বিস্ময়কে, সৌন্দর্যকে সম্মান করেছ। এই জায়গায় আমরা সেটা করতে পারিনি। কেন পারিনি, সেটা আকাশ বলতে পারবে।আকাশ সব জানে – আকাশের চেয়ে বিশালতো আর কিছু নেই!’ তাকিয়ে তাকিয়ে বৃদ্ধার চলে যাওয়া দেখছিলাম।
শব্দটা তখনও ভাসছিল – ‘আকাশ সব জানে – আকাশের চেয়ে বিশালতো আর কিছু নেই!’
এ কথা কিন্তু ভিক্টর হুগো মানবেন না – লা মিজারেবলে মানুষের আত্মাকে তিনি আকাশের থেকেও বড় করে তোলেন।‘There is one spectacle grander than the sea, that is the sky; there is one spectacle grander than the sky, that is the interior of the soul.’ তাঁর মতে আত্মা নাকি আকাশের চেয়েও মাহাত্ম্যপূর্ণ! কী জানি – আমিতো এমনিতেই মাইনাস পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করে বাইরেটা দেখি, আত্মার অন্তঃস্থলের মতো সূক্ষ্ম জিনিস দেখা আমার কাজ নয়। তারচেয়ে মাথার ওপর বিশাল আকাশ দেখতে দেখতে আমি বরং শৈশবের কোলে উঠে আবার নিজেই আকাশ হয়ে যাই। আর একবার নাহয় শৈশবের মতো নিখাদ স্বার্থপর হই, সুন্দর কিছু দেখলেই মুগ্ধতা মাখা অকৃত্রিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সেই দেড়শো বছরের বুড়োর থেকে ধার করে ফুঁপিয়ে উঠি – ‘তুমি আমারই, তুমি আমারই – মম অসীম গগন বিহারী’।
৩।২০১৫ এর অক্টোবরের মাঝামাঝি।
সরকারী কাজে ব্রুনেই গিয়েছি। সফরের দ্বিতীয় দিনে সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করেছেন। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ব্রুনেইয়ের সুলতানের আপন ভাই। সুলতানের মত তাঁর ভাইয়েরও একটা ঝলমলে প্রাসাদ আছে। সেই প্রাসাদেই লাঞ্চ। ঝলমলে প্রাসাদে টলমলে খাবার। খাবার টেবিলে বসে কূটনীতিকরা আলাপ শুরু করে কুইজিন (cuisine) নিয়ে। খাবারের মেনু কার্ডে চোখ বুলায় – আর যেন রসুই ঘর থেকে চলে আসে কথার রসদ। শুরু হয় ছোট ছোট আলাপ। খাবার মানে তো শুধু খাবার নয়। খাবারে মিশে থাকে সংস্কৃতি। পরিবেশনের ধরণে থাকে শিল্পবোধ। টেবিলের পরিবেশে ফুটে ওঠে গৃহস্বামীর আতিথেয়তা। পুরো বিষয়টাকে কূটনীতিকরা বলেন – পেটের ভেতর দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ। আর সোজা বাংলায় – খাওয়াইয়া মন ভুলান।
এসব ক্ষেত্রে খেতে বসলে আমি আমন্ত্রণকারীকে মন ভুলানোর যথেষ্টই সুযোগ দেই। যতটুকু পারি খাই আর খাবার সাথে আহা, উহু করতে থাকি। যেন এর চেয়ে ভালো খাবার আমি জীবনেও খাইনি – আর ভবিষ্যতেও খাব কিনা সন্দেহ আছে। তো সেদিন আমার টেবিলে বসেছেন ব্রুনেইয়ের ডেপুটি চিফ অফ প্রটোকল (DCP)। ভীষণ রসিক মানুষ। আমি এক একটা খাবারের কথা জিজ্ঞেস করি, আর তিনি আগ্রহ নিয়ে সেটার ধারাভাষ্য দেন। বুঝা যাচ্ছিলো – তিনি বেশ এনজয় করছেন। চোখে মুখে বেশ একটা গর্ব গর্ব ভাব। আমিও মুগ্ধ হবার ভান করেই যাচ্ছি। মুগ্ধতার সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো – মুগ্ধ হতে পয়সা লাগে না। বরং বেশি বেশি মুগ্ধ হলে, লাভ হবার সম্ভাবনাই থাকে। মুগ্ধ হতে যদি পয়সা লাগত – আমি নিশ্চিত, আমি সেদিন দেউলিয়া হয়ে যেতাম। খাবারের মেনুতে দেখি মালয়, থাই, চাইনিজ এমনকি আমাদের চিকেন তন্দুরিও আছে। আমি গদগদে হয়ে বললাম, ‘ওয়াও, ইটস ডাইভারস টেস্ট – একেবারে পাঁচমিশালী স্বাদ’। ডিসিপি সাহেব মোটামুটি চেঁচিয়ে ওঠলো – ‘ইয়েস, ইয়েস, আনিকা! আনিকা রাসা’! আমি অবাক। বললাম, আনিকা? আনিকা তোমার কে হয়?
-কে হয় মানে?
– বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ক্লাসমেট ছিলো, নাম আনিকা। আর তিনি এখন আমার তখনের রুমমেটের স্ত্রী।
-ও! না না, আনিকা কারো নাম নয়। আমাদের ভাষায় আনিকা মানে ডাইভারস (বৈচিত্রপূর্ণ), আনিকা রাসা – ডাইভারস টেস্ট।
– ‘হুম, তাই বলো! তোমাদের পাঁচমিশালী স্বাদের কথা বলতে তুমি আনিকারে ডাক দিয়েছো। কিন্তু ডাক দিয়ে তো লাভ নেই। আমাদের আনিকা এখন স্বামীর সাথে কানাডায়। তোমার ডাক শুনতে পাবে না’। সবাই হো হো করে হেসে ওঠলো। বেশ জমে উঠলো আলাপ। চায়ের কাপ তখনো আসে নি, তাই চামচ আর ছুরিতেই ঝড় উঠলো।
ওদিকে লাঞ্চের সাথে অতিথিদের জন্য গানের ব্যবস্থাও ছিলো। হল ঘরের এক পাশে শিল্পীরা গাইছিলো ধীর লয়ের সুন্দর মালয় সঙ্গীত। কিছু কিছু গানের সুর একেবারে আমাদের মত। আমরা গান নিয়ে আলাপ শুরু করলাম। এক সময় জিজ্ঞেস করলাম, ব্রুনেইয়ের জাতীয় সঙ্গীত কি?
ডিসিপি সাহেব নিরব। কিছু বলছেন না। একটু আগে তাঁর মুখে যে অহংকারের ভাবটা ছিলো, সেটা যেন হঠাৎ উধাও। ঘটনা কি? কোন অন্যায় করে ফেললাম নাকি? আমি তো একটা নিষ্পাপ প্রশ্ন করেছি মাত্র! আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি? উনি আমতা আমতা করে মৃদু স্বরে বললেন, ‘অ্যা…… ইট ইজ লাইক দ্য ব্রিটিশ ওয়ান’।
মনে পড়লো, ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীত – ‘God Save the Queen’ – স্রষ্টা যেন রাণীকে রক্ষা করেন।
পরে জেনেছি – ইংরেজিতে ব্রুনেইয়ের জাতীয় সঙ্গীতের শুরুটা হলো – ‘O God, bless His Majesty with a long life’ – স্রষ্টা যেন সুলতানকে দীর্ঘ জীবন দান করেন। দেখলাম, যেসব দেশে রাজা-রাণী আছে, জাতীয় সঙ্গীতে সেসব দেশের অবস্থা এরকমই। রাজা-রাণীদের মাহাত্ম্য। আর অন্য বেশির ভাগ দেশের জাতীয় সঙ্গীতে সেই দেশ যে শ্রেষ্ঠ – ঐরকম কথাবার্তায় ভরা। একটা স্পষ্ট অহংকারী টোন। অন্য দেশ ছোট – আমাদের দেশ বড় এইরকম।
সেদিন ব্রুনেইয়ে বসে আমি উপলব্ধি করলাম – অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীত এমন যে অন্য দেশের মানুষের সামনে সেটি বলতে সংকোচ হতে পারে। ব্রুনেইয়ের রসিক অফিসারটিকে জাতীয় সঙ্গীতের প্রসঙ্গে চুপ করে যেতে হলো। তিনি আমার সামনে তাঁদের জাতীয় সঙ্গীত বললেনই না। শুধু ‘ব্রিটেনের মত’ বলেই তাঁকে থেমে যেতে হলো। আমি বুঝলাম – এই জায়গায় একজন বাংলাদেশি কূটনীতিক হিসেবে আমি অনেক ভাগ্যবান। সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করলাম – আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি কত চমৎকার। কত আধুনিক। অন্য কোন দেশের কূটনীতিক জিজ্ঞেস করলে মাথা উঁচু করে বলতে পারি – My Bengal of gold, I love you.
আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে বাংলাদেশ আমাদের মা। আমরা সেই মাকে ভালোবাসি। বাংলাদেশের আকাশ- বাতাস, শোভা-ছায়া, স্নেহ-মায়া আমরা ভালোবাসি। বাংলাদেশ একটা আঁচল বিছায়ে রেখেছে আমাদের জন্য। সেই মায়ের মুখ মলিন হলে, আমাদের চোখ জলে ভরে ওঠে। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন, জলে ভাসি।’
রবীন্দ্রনাথের প্রতিটা সৃষ্টিই একটা সুন্দর পরশের মতো। জাপটে ধরে না। আলতো করে মনের উপর বুলিয়ে যায়। আমাদের জাতীয় সংগীতও তেমনি। কেমন একটা ভিজে ভিজে পরশ এর সুরে। একটা তুলতুলে ভালোবাসা এর প্রতিটি লাইনে।
শুধু দেশপ্রেম আর দেশের প্রকৃতি দিয়ে এমন চমৎকার জাতীয় সঙ্গীত পৃথিবীতে বিরল। অন্যকে ছোট করে নয়; নিজেকে বড় করে নয়; রাজা-রানীর জন্য প্রার্থনা করে নয়; ভালোবেসে শুধুই দেশকে ভালোবেসে আমরা সবার সামনে বলে উঠি –
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’
// সুজন দেবনাথ
…………………………………………………
সক্রেটিসের নগরে রবীন্দ্রনাথ ||
[১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ একটানা ছয় মাস ইউরোপের কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেন। সেই ভ্রমণ ছিলো একই সাথে সফল এবং বিতর্কিত। ইতালীতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর অতিথি হয়েছিলেন বলে একদিকে কবির সমালোচনা হয়েছে, আর অন্যদিকে ইউরোপের প্রতিটি নগরে হাজারো মানুষ ছুটে এসেছে তাকে এক নজর দেখতে। সব মিলিয়ে ভ্রমণটি ছিলো রোমাঞ্চে ঘেরা। কিন্ত সেই রোমাঞ্চিত ভ্রমণের তেমন বিস্তারিত বিবরণ কোথাও নেই। এই না থাকা নিয়ে কবির নিজের আক্ষেপ ছিলো, শেষ জীবনেও তিনি এটি নিয়ে আফসোস করেছিলেন। ১৯৪১ সালে ৬ এপ্রিল তিনি লিখেছিলেন, ‘এই আশ্চর্য ইতিহাসটিকে লিপিবদ্ধ করিবার জন্য বাইরের সাক্ষ্যর প্রয়োজন আছে’। আবার এই আক্ষেপের কথা ভ্রমণসঙ্গী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও তার স্ত্রীকে কবি লিখেছেন, ‘যা কোথাও প্রকাশ পেলো না তার দাম খুব বেশি।’ তো এই ‘যা কোথাও প্রকাশ পেলো না’, তার কিছু অংশ বের করতে চেষ্টা করেছি। সেই ভ্রমণে কবি এথেন্সে এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ২৫ নভেম্বর। ছিলেন মাত্র নয় ঘণ্টা। আমি এথেন্সে এসে চেষ্টা করেছি সেই ভ্রমণের খুঁটিনাটি বের করতে। সেই সময়ের এথেন্সের পত্রিকা, গ্রিক ভাষায় প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধ, কবির পত্রাবলী আর জীবনী ঘেঁটে গল্পের ঢঙে বলতে চেয়েছি রবীন্দ্রনাথের এথেন্স ভ্রমণ। ]
১৯২৬ সালের ২৫ নভেম্বর।
খুব সকালে এজিয়ান সাগরের গাঢ় কুয়াশা কেটে চলছে জাহাজ ‘এমপারোর ট্রাজান’। রোমের সম্রাট ট্রাজানের নামে এই জাহাজের নাম। জাহাজটি ইস্তাম্বুল নগর থেকে এথেন্সের দিকে চলছে। গন্তব্য এথেন্সের পিরাউস বন্দর। ঘন কুয়াশার ভেতর মর্মর সাগর আর এজিয়ান সাগরের বিশাল জলরাশি পার হয়ে জাহাজটি খুব সকালে এথেন্সের পিরাউস বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছল। দূরে থেকে একটা লাইট হাইজের বাতি একটু একটু দেখা যাচ্ছে। এমনিতে এইসব জাহাজ যাত্রার তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। সপ্তাহে তিন দিন ইস্তাম্বুল থেকে জাহাজ আসে এথেন্সে। কিন্তু আজকের এই জাহাজ ‘এমপারোর ট্রাজান’ এর আলাদা মাহাত্ম্য আছে। এই জাহাজে করে এথেন্সে আসছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দ্যা গ্রেট টেগোর। নোবেল জয়ের পর ইউরোপে তিনি এখন সেলিব্রেটি। ইউরোপের যেখানেই যান, মিডিয়ায় শোর ওঠে – ‘শুনেছ, টেগোর আসছেন শহরে’।
জাহাজ এগিয়ে চলছে। কবি প্রতিদিনই ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করেন। প্রভাত সূর্যের সাক্ষাৎ না করে দিন শুরু করেন না। পয়ষট্টি বছর বয়সেও এই নিয়মের কোন বেত্যয় নেই। আজও খুব সকালেই জাহাজের প্রথম শ্রেণীর কেবিন থেকে বের হলেন রবীন্দ্রনাথ। ঘন কুয়াশায় সূর্য দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা লালচে ঊষার আভা ভেসে উঠেছে পূব আকাশে। সেই আভাতেই সাগরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। অগাধ জলরাশির মধ্যে পাহাড়ের মত ভেসে আছে এক একটা দ্বীপ। কবি বুঝলেন, তিনি গ্রীসের খুব কাছে এসে পড়েছেন। দার্শনিক পেল্টো সাগরের বুকে গ্রীসের এই দ্বীপগুলো দেখে বলেছিলেন, ‘বিশাল পুকুরের মাঝে যেন কতগুলো ব্যাঙ ভেসে আছে’। এতোদিন গ্রীসের এই দ্বীপগুলো ছিলো কবির দূরের বন্ধু। প্রতিবার ইউরোপে যাবার সময় জাহাজ থেকে ইতালির আগে গ্রিসের এই দ্বীপগুলো নজরে আসতো। বামদিকে ক্রীট দ্বীপের পাহাড়গুলো দেখলেই তিনি অনুমান করতেন, তাঁর জাহাজ ইউরোপে পৌঁছে গেছে। আজ আর অনুমান নয়, সত্যিই এই দ্বীপগুলো তাঁর অনেক কাছে। স্বপ্নের গ্রীস খুব নিকটে চলে এসেছে।
কবির মনে পড়লো অনেক দিন আগে দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রার সময় এই দ্বীপগুলো দেখতে দেখতে মৃণালিনী দেবীর কথা অনেক মনে পড়ছিলো। মৃণালিনী তখন মাত্র সতের বছরের কিশোরী। আর সেই সতের বছরেই দুটি সন্তানের জননী। সেবার স্ত্রী-সন্তানদের একা রেখে ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বন্ধু লোকেন পালিতের সাথে বিলেত যাচ্ছিলেন তিনি। যাত্রার পথে তার কেবলই মৃণালিনীর কথা মনে পড়ছিলো। জাহাজ থেকে মৃণালিনীকে লিখেছিলেন,
‘ভাই ছোট গিন্নী,
…… আমরা, ধরতে গেলে পরশু থেকে য়ুরোপে পৌঁচেছি। মাঝে মাঝে দূর থেকে য়ুরোপের ডাঙ্গা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের জাহাজটা এখন ডানদিকে গ্রীস আর বাঁ দিকে একটা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে চলেছে। দ্বীপটা খুব কাছে দেখাচ্ছে – কতগুলো পাহাড়, তাঁর মাঝে মাঝে বাড়ি, এক জায়গায় খুব একটা মস্ত সহর – দূরবীন দিয়ে তাঁর বাড়িগুলো বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলুম – সমুদ্রের ঠিক ধারেই নীল পাহাড়ের কোলের মধ্যে শাদা সহরটি বেশ দেখাচ্ছে। তোমার দেখতে ইচ্ছে করছে না ছুটকি? তোমাকেও একদিন এই পথ দিয়ে আসতে হবে তা জান?’
না, মৃণালিনী কোনদিন এইপথ দিয়ে আসেন নি। ইউরোপ দেখার সাধ পূর্ণ হবার আগেই সেই চিরবিরহিনী চলে গেছে কবিকে একা রেখে। সেই সময় কবি তাকে ‘ছোট গিন্নী’ বলতেন। চিঠি লিখতেন ‘ভাই ছোট গিন্নী’ বলে। ঠাকুর বাড়ির ছোট বউ বলে আদর করে ডাকতেন ‘ছুটি’। চিঠিতে লিখতেন ‘ভাই ছুটি’। সেই ‘ছুটি’ অনেক বছর আগেই ছুটি নিয়ে চলে গেছে তাকে ছেড়ে। আজ আবার গ্রীসের এই দ্বীপগুলো দেখে কবির সেই চিঠির কথা মনে পড়লো। মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে গেলো। এখন অমন একটা চিঠি লেখার মত একজন মানুষও তাঁর নেই। জীবনের কিছু দুঃখ কখনও শেষ হয় না, কিছু ক্ষত কোনদিনই পূরণ হয় না। তিনি কেবিনে ফিরে গেলেন। কলম হাতে নিলেন।
কবির শরীর তেমন সুস্থ নয়। দীর্ঘ ভ্রমণে ভীষণ ক্লান্ত। কিছুদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একটানা ছয় মাসের উপরে হয়ে গেলো – ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরছেন আর বক্তৃতা করেছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর বক্তৃতার কদর আছে আর এ থেকে বেশ দু’পয়সা আয় হয়। শান্তিনিকেতনের বিপুল খরচ যোগাড় করার জন্য এই টাকাটা ভীষণ প্রয়োজন। এটা টের পেয়ে পশ্চিমের কিছু পত্রিকা ক’বছর আগে তাকে ‘ডলার কামানো বক্তা’ বলে গালি দিয়ে নানান কথা লিখেছে। কিন্তু সেই পত্রিকায়ালারা তো আর জানে না – কবি এই ডলার দিয়ে কী করছেন। পশ্চিমের গুণীরা যেখানে একবার নোবেল প্রাইজ পেলে, সেই টাকা দিয়ে বেশ আরামেই জীবন কাটায়, সেখানে এই বাঙ্গালী কবি তাঁর সব কিছু দিয়ে শান্তি নিকেতন চালাচ্ছেন। শিক্ষার জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশ থেকে দেশে ছুটে যাচ্ছেন। এজন্য মিডিয়ার সমালোচনা গায়ে মাখলে চলবে না। কিন্তু যেটা গায়ে মাখতে হয়, সেটা হলো – টাকার ফাঁদে ফেলে দুষ্ট লোকদের মন্দ অভিসন্ধি। এবারের ইউরোপ ভ্রমণটা শুরুই হয়েছিলো ওইরকম একটি অভিসন্ধি দিয়ে। কূটচাল দিয়ে ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনী আমন্ত্রণ করেছিলো কবিকে।
মুসোলিনী ভীষণ ধুরন্ধর মানুষ। সে চেয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পাল্লা ভারী করতে। তখনো কবি মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কথা ভালো করে জানতেন না। ইতালি যাবার নিমন্ত্রণ নিয়ে এলো কবির পরিচিত ইতালিয়ান অধ্যাপক ফর্মিকি। সংস্কৃত ভাষা আর বৌদ্ধ সাহিত্যের অধ্যাপক এই ফর্মিকি। তিনি লাল-ভোল দিয়ে ১৯২৬ সালের মে মাসে কবিকে নিয়ে গেলেন ইতালীতে। সেখানে শান্তিবাদী কবি সাদা মনে মুসোলিনীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন। ইতালীর ফ্যাসিস্ট পত্রিকাগুলোতে সেই খবর প্রকাশিত হলো উল্লাসের সাথে। তারা লিখলো, দেখো, এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী দ্যা গ্রেট টেগোর সমর্থন করে মুসোলিনীকে। তবে অচিরেই কবি টের পেলেন মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী রূপ। তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন মানুষের শঠতা দেখে। অধ্যাপক ফর্মিকি তাকে ঠকিয়েছে, মুসোলিনী সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে মঞ্চে তুলেছে। টের পেয়েই কবি ইতালি ত্যাগ করলেন। কিন্তু ভুল করে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করার জন্য কবির মনে তীব্র অন্তর্জ্বালা শুরু হলো। সুইজারল্যান্ডে গিয়ে দেখা হলো রমাঁ রলাঁর সাথে। তাঁর কাছে ফ্যাসিজমের ভয়ংকর আগ্রাসনের কথা শুনলেন। অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ভীষণ মনোবেদনা নিয়ে যখন ভিয়েনা পৌঁছলেন, তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। লন্ডনে চিকিৎসা নিলেন। চিকিৎসার পর প্রথম বক্তৃতায়ই ফ্যাসিবাদকে পৃথিবীর অভিশাপ বলে সমালোচনা করলেন। এরপর নরওয়ে, ডেনমার্ক, জার্মানি, হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া থেকে ইস্তাম্বুল (কনস্টান্টিনোপল) হয়ে এখন এথেন্সের পথে। এই দীর্ঘ ভ্রমণ, অসুস্থ শরীর আর বিধ্বস্ত মন নিয়ে কবি চলেছেন সক্রেটিসের নগরে।
গ্রীসের সুন্দর দ্বীপগুলো দেখে বেশ ভালো লাগলো। আবার পরক্ষণেই মৃণালিনীকে লিখা চিঠির কথা মনে পড়লো। আনন্দ আর বিষাদ নিয়ে অসুস্থ কবি কলম হাতে নিলেন। গত কয়েক মাসে তেমন কিছু লিখেননি তিনি। মুসোলিনীর চক্রান্ত তার কলমকে থামিয়ে দিয়েছিলো। এখন এথেন্সের জ্ঞানের দেবী এথিনা মনে হয় তাকে বর দিলেন। ৬৫ বছরের রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথমে বিষাদের কথাই মনে হলো। মনে হলো, জীবনের সকল পাওয়া আর না-পাওয়া সবই মরীচিকা, সবই মিছে। তিনি লিখলেন,
‘ক্ষত যত ক্ষতি যত – মিছে হতে মিছে,
নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে
কী হল না, কী পেলে না, কে তব শোধে নি দেনা
সে সকলই মরীচিকা মিলাইবে পিছে
মিছে হতে মিছে’
ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। জাহাজ এথেন্সের কাছে চলে এসেছে। সকালের সূর্যের সাথে কবি জাহাজে বসে দেখলেন সুন্দরী এথেন্সকে। মুগ্ধ হয়ে তাকালেন পাহাড়-সাগর-দ্বীপ ছুঁয়ে দাড়ানো জ্ঞান প্রসবিনী রাজধানীটির দিকে। জ্ঞানের দেবী এথিনার শহর এথেন্স – দেবীর মতই সুন্দর। এ এক অপরূপ ছবি। কবি লিখলেন,
‘এই-যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি
অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি-
এই তো পরম দান সফল করিল প্রাণ,
সত্যের আনন্দরূপ এই তো জাগিছে
ক্ষত যত ক্ষতি যত – মিছে হতে মিছে’
চিরকাল সত্যের সন্ধান করা কবি এথেন্সকে প্রথম দেখেই সত্যের আনন্দরূপ টের পেলেন। জ্ঞানের নগরী তাকে সত্যের সন্ধান দিলো। লেখাটি শেষ করে বেশ প্রসন্ন হলেন রবীন্দ্রনাথ।
জাহাজে কবির সাথে আছেন ছেলে রথীন্দ্রনাথ আর পুত্রবধু প্রতীমা দেবী। প্রতিমাকে কবি অত্যন্ত স্নেহ করেন। ঠাকুর পরিবারের প্রথা ভেঙে বিধবা প্রতিমার সাথে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। এই পুত্রবধুই এখন কবির সংসারের কর্ত্রী। রথী-প্রতিমা দম্পতি নিঃসন্তান। কিছুদিন আগে একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন তারা। কবি নিজেই এই নতুন নাতনীটির নাম দিয়েছেন নন্দিনী। নন্দিনীর বয়স এখন তিন বছরের একটু বেশী। নন্দিনীও কবির সাথে এবারের জাহাজে আছে।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ কাজের মানুষ। সব কিছুতেই ভীষণ প্রাকটিকাল তিনি। এই ভ্রমণে তিনি সঙ্গে এনেছেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষকে। কবি এবং কবিপুত্র দুজনেই চান বাংলার কৃষকদের মধ্যে সমবায় সমিতি চালু করতে। গ্রামের মানুষদের ঋণদানের জন্য তারা অল্পপূঁজির আলাদা এক ধরনের ব্যাংক বানাবেন। সমবায় সমিতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের জন্য রথী এবার গৌরগোপাল ঘোষকে ইউরোপে নিয়ে এসেছেন। পুত্রের এই বিচক্ষণতায় কবি খুশী হয়েছেন।
কবির সাথে আরও আছেন বিশ্বভারতীর কর্মসচিব বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং তার স্ত্রী রাণী মহলানবিশ। এই দম্পতি কবির এবারের ইউরোপ ভ্রমণের সব সময়ের সঙ্গী। ভ্রমণের সব রকম ব্যবস্থার দায়িত্ব কর্মপটু প্রশান্তচন্দ্রের উপর। আর বিদেশ বিভূঁইয়ে কবির চলমান সংসারের দায়িত্ব রাণীর। এই দম্পতিকে কবি বড়ো ভালোবাসেন। সেই কিশোর বয়স থেকেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ রবীন্দ্র অনুরাগী। বিশ্বভারতীর শুরু হতেই তিনি কবির সাথে আছেন।
লেখাটা শেষ করে জলের উপর সূর্যের খেলা দেখছিলেন কবি। প্রতিমা দেবী কেবিনে ঢুকলেন। বললেন, বাবা, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নাকি জাহাজ ভীড়বে। আপনাকে স্বাগত জানাতে অনেকে চলে আসার আগেই সকালের খাবার শেষ না করলে কিন্তু মুসকিল হবে। সকালের খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।
কবি বললেন, হুম, তোমার যখন হুকুম – কী আর করব! রথী উঠেছে?
জাহাজের ক্যান্টিনে সকলে মিলে নাস্তা করছেন। কবি বললেন, দেখো, কী অপূর্ব এথেন্স। বড়ো সাধ ছিলো এথেন্স ভালো করে ঘুরে দেখার। পার্থেনন দেখবো, প্লেটোর একাডেমির জায়গাটা দেখতেও খুব ইচ্ছে করে। এবার মনে হয় সেসব দেখা হলো না।
কবির গ্রোগ্রাম ঠিক করেন প্রশান্তচন্দ্র। তিনি বললেন, হুম গুরুদেব। শুধু শুধু জাহাজটা ইস্তাম্বুলে এক দিন দাঁড়িয়ে রইলো।
– জাহাজের আর কী দোষ, বলো। কুয়াশা আর আমাদের অদৃষ্ট। না হলে, আমার আসার দিনই কুয়াশায় জাহাজ আটকে থাকবে কেন। ইস্তাম্বুলের জলের উপর মিছে মিছে কেটে গেল একটা দিন।
রাণী বললো, দুই দিনের সফর কেটে হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার। সব আশা মাটি হলো।
কবি হালকা স্বরে বললেন, ‘মিছে হতে মিছে’।
প্রতিমা বললো, বাবা, নতুন গান নাকি! আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না।
কবি মৃদু হাসলেন, একটু আগেই লিখলাম। সুন্দরী এথেন্স আমার হাতে কলম তুলে দিয়েছে। এথেন্স মায়া জানে। কিন্তু শুধু মায়া দিয়েই তো হবে না। প্রশান্ত, আজকের প্রোগামের কি করলে?
প্রশান্তচন্দ্র উত্তর করলেন, গুরুদেব, যাত্রার বিলম্বের জন্য গতকালের সকল প্রোগ্রাম বাতিল করতে হয়েছে। গতকাল রাতে আপনার সম্মানে ডিনারের আয়োজন করেছিলো গ্রীসের সাহিত্য পরিষদ। এখন সেটাকে আজকের লাঞ্চ করতে হয়েছে। লাঞ্চের স্থান আগেরটাই আছে। হোটেল গ্রেট ব্রিটেন। আর গ্রীক সরকার কিভাবে পুরস্কার তুলে দেবে সেটা এখনো ফাইনাল হয়নি।
– পুরস্কারটার নাম যেন কি?
হেসে উঠলেন প্রশান্তচন্দ্র। গত কয়েক বছর যেখানেই যাচ্ছেন, সবাই পুরস্কার দিচ্ছেন কবিকে। তাই এখন আর অত ঘটা করে নাম মনে রাখার গরজ নেই কবির। প্রশান্তচন্দ্র ডায়েরী চেক করে বললেন, পুরস্কারের নাম ‘কমান্ডার অফ দ্যা অর্ডার অফ দ্যা রিডিমার’। গুরুদেব, এটা কিন্তু গ্রীসের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পদক। এখানকার প্রেসিডেন্ট নিজ হাতে এই পদক তুলে দেন। গতকাল সব আয়োজন ছিলো। জাহাজ সময়মত না আসায় সেই প্রোগ্রাম ভেস্তে গেলো। এখন দেখি – নতুন কি ব্যবস্থা করেছে? কিছু না হলে ব্রিটিশ এম্বাসীর মাধ্যমে কোলকাতা পাঠিয়ে দিতে বলবো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কবি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এই পদক কি সক্রেটিস বা প্লেটো পেয়েছে?
সবাই হো হো হেসে উঠলো। কবি মাঝে মাঝেই এমন রসিকতা করেন। সক্রেটিসের সময় গ্রীস নামে কোন দেশই ছিলো না। সেই দেশের আবার পদক হবে কি করে!
কবি বললেন, এথেন্সের পার্থেননটা কিন্তু অবশ্যই দেখবো। সেটা কিন্তু মিস করো না। শতবার পুরস্কার নেয়ার চেয়ে একবার পার্থেনন দেখার দাম অনেক বেশি।
কবি যখন একথা বলছিলেন, জাহাজ ভীড়ার শব্দ শুনা গেলো। এথেন্সের পিরাউস বন্দরে নোঙর করলো ‘এমপারোর ট্রাজান’।
কবি মুগ্ধ হয়ে দেখলেন এথেন্সের মাটি। এই মাটিতে একদিন আলো জন্ম নিয়েছিলো। ইউরোপের সকল আলোর জন্ম হয়েছিলো এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে। গণতন্ত্র, দর্শন, থিয়েটার, চিকিৎসা – পশ্চিমের সব কিছু এই নগরী থেকেই শুরু হয়েছে। বিস্ময় নিয়ে দেখছিলেন কবি।
২.
পিরাউস বন্দরে অনেক ভোর থেকে গ্রিসের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা বসে আছে কবিকে স্বাগত জানাতে। অনেকেই গতকাল থেকে অপেক্ষা করছে। জাহাজ মাত্র নোঙর করেছে। বন্দরের লোকেরা বললো, প্লিস, এখন কেউ জাহাজে উঠবেন না। আমরা বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন প্লিস। কিন্তু কবি সাহিত্যিকরা তো মুক্ত প্রজাতির প্রাণী। ওইসব বাধা নিষেধ তারা মানেন নাকি। জাহাজে উঠতে না পেরে ছোট নৌকা জোগাড় করে ফেললো। সেই নৌকায় কয়েকজন পৌছে গেলো জাহাজে। দুই দিন ধরে তারা বন্দরে অপেক্ষা করছে। গতকাল আসার কথা ছিলো কবির। তাদের আর দেরী সইছিলো না।
টেগোর নামটি এখন সারা ইউরোপ জুড়ে এক সেনসেশান। গ্রিক কবিদের কাছেও তিনি এক রহস্য। গ্রিকরা তো জানতোই না যে বাংলা নামে একটা ভাষা আছে, একটা ভূখণ্ড আছে। তারা শুধু জানতো – গ্রিক বীর আলেকজান্ডার পারস্য জয় করে ভারতেও আক্রমণ করেছিলো। ভারতে কিছু অংশ জয়ও করেছিলো আলেকজান্ডার। কিন্তু গঙ্গারীডয় নামে এক নদীর তীর থেকে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন। সেই গঙ্গারিডয় আসলে গঙ্গা নদী। সেই নদীর অপর পাড়েই বাংলা। ইতিহাসের জনক হিরোডটাসের লেখা থেকে গ্রিকরা সেই দেশ সম্পর্কে জেনেছিলো। হিরোডোটাস লিখেছিলো – ওই দূরে ইন্ডিয়া নামে এক দেশ আছে, সেখানের মানুষ সব বর্বর, তারা কালো জাদু জানে, তাদের রঙ কালো, এমনকি সেখানের পুরুষদের শুক্রানুও নাকি কালো।
হিরোডোটাসের এই অদ্ভুত তথ্যের বাইরে ভারতবর্ষ সম্পর্কে গ্রিকরা শুধু দুইটা নতুন তথ্য জানতো। এক – এখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করে, সেখানের অসভ্য মানুষদের সভ্য করছে। দুই, ভারতবর্ষে নাকি প্রাচীনকালেও কিছু জ্ঞানী মানুষ ছিলো, যাদের বলা হয় ঋষি। জার্মানরা ইদানিং সংস্কৃত ভাষায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেক জার্মান পণ্ডিত সংস্কৃত থেকে সেই ঋষিদের জ্ঞানের কথা ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেছে। সেখান থেকে গ্রিকরা জেনেছে, প্রাচীন ঋষিরা বনে থাকতো, তাদের লম্বা লম্বা দাড়ি, তারা ঈশ্বরের সাধনা করত।
এই জ্ঞান নিয়ে গ্রিক কবি সাহিত্যিকরা একদিন শুনলো, সেই বর্বর দেশের বাংলা ভাষার এক কবি সাহিত্যে নোবেল পেয়ে গেছে। তারা তো তাজ্জব! সারা ইউরোপের সাথে সাথে গ্রিকরাও খোঁজ নিতে শুরু করলো – কে এই কবি। তারা শুনল – এই কবির নাম টেগোর। পত্রিকায় ছবি দেখলো – লম্বা চুল, কাঁচা-পাকা দাঁড়ির এক সুপুরুষ। তারা ভাবলো, আরে, এই তো সেই প্রাচীন ভারতের ঋষি। সেই একই রকম চুল-দাড়ি। তারা কবিতা পড়ল। ‘দ্যা সং অফারিংস’ বা গীতাঞ্জলী। সেখানেও ঈশ্বরের প্রেমের কথা। তাহলে তো রবীন্দ্রনাথ আর কেউ নয়। সেই প্রাচীন ঋষি। সেই রহস্য ঘেরা পুরুষ। তাকে নিয়ে তখন ইউরোপের ঘাটে-মাঠে আলোচনা। তার পোশাক দেখলো। লম্বা আলখাল্লা, কেমন এক জোব্বা-জাব্বার মত। একেবারে চার্চের পাদ্রীর উপর। দেখেছো মুখখানা কেমন যীশুর মত। আবার অনেকে ধর্মের দিকে গেলো না। তারা বললো, রবীন্দ্রনাথে চেহারা আসলে তলস্টয়ের মতো। সব মিলিয়ে টেগোর ইউরোপে একটা বিশেষ ব্রান্ড। সেই টেগোর গ্রিসে আসছেন! তার জাহাজ এখন এথেন্সের বন্দরে। গ্রিসের সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের তর সইবে কী করে। তারা নৌকা করে কাছে এসে জাহাজে উঠে গেলো।
দেশের খ্যাতিমান লোকদের এমন আচরণ নাবিকরা আগে দেখেনি। তারা জাহাজে খবর দিল। নাবিকেরা তাদের নিয়ে গেল প্রথম শ্রেণীর ডাইনিং হলে। কবি মাত্র নাস্তা শেষ করেছেন। কবি সাহিত্যিকরা তুমুল করতালী দিয়ে উচ্চস্বরে সেই ডাইনিং হলেই প্রথমবার কবিকে স্বাগত জানালো। তরুন কবি রিনা আফগারী কবির হাতে তুলে দিলো একটি জলপাই শাখা। রীনা বললেন, মহান কবিকে এথেন্সে স্বাগত। জলপাই আমাদের গ্রিসের মংগলের প্রতীক। এথেন্সের দেবী এথিনা আর দেবতা এপোলোর দুজনের হাতেই এই জলপাই শাখা থাকতো। এথেন্সে প্রথমে আসলে আমরা সবাইকে জলপাই শাখা দিয়েই স্বাগত জানাই।
কবি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জলপাইয়ের কচি পাতা দেখতে লাগলেন। এরপর গ্রীসের সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবিকে স্বাগত জানালেন। তিনি ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন। কবি স্মিত হাস্যে বললেন, কেউ কি আমাকে একটু ইংরেজী করে দেবেন।
এতোদিনে জনসভার বক্তৃতার মত করে কথা বলাটা বেশ ভালোই শিখে ফেলেছেন কবি। তিনি সমাগত সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বললেন, আমি আপনাদের মাঝে এথেন্সে এসেছি। কী যে আনন্দ হচ্ছে। আমার সামনে আলোর নগরী এথেন্স। বিশ্বাস হচ্ছে না। ছোটবেলা থেকে ভেবেছি এখানে আসব। আজ সেই আশা পূরণ হচ্ছে। এই ভোরের শীত সহ্য করে আমাকে গ্রহণ করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। অন্তর থেকে ধন্যবাদ।
এরপর কবিকে অবাক করে দিয়ে সেই ডাইনিং হলেই সাংবাদিকরা শুরু করলো প্রশ্ন। গ্রিসের মানুষের কাণ্ডজ্ঞান ইউরোপের অন্য দেশের থেকে আলাদা। নিয়মের অতো বাড়াবাড়ি মনে হয় এখানে নেই। যার যা ভালো লাগছে, করে ফেলছে। ডাইনিং হলেই প্রশ্ন করা শুরু করেছে। কবি দেখলেন, সত্যি সত্যিই জাহাজের ডাইনিং হলটা তার প্রেস কনফারেন্স রুম হয়ে গেছে। জাহাজের অফিসার অসহায়। অন্য যাত্রীদের অসুবিধা করে এখানেই সাংবাদিকরা টেগোরকে জেঁকে ধরেছে। নাবিকরা বাধা দিতে পারছে না। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে যাচ্ছে –
টেগোর আপনি গ্রীসে কেন এসেছেন? টেগোর, আপনার ভাষার সাথে গ্রিসের কি কোন মিল আছে? টেগোর, আপনি কি ঋষি? আচ্ছা, প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল পেয়ে সেদিন আপনার কেমন লেগেছিলো?
কবি দেখলেন – বিপদ। কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবেন। তিনি কোনটারই উত্তর দিলেন না। নিজের মত করে বললেন, আমি চাই সারা পৃথিবীর মানুষ এক সুরে সুন্দরের কথা বলবে, মানুষে মানুষে কোন ভেদ থাকবে না। সেই ঐক্যের খোঁজেই আমি দেশ থেকে দেশে ছুটে যাই, সেজন্যেই ইউরোপে এসেছিলাম, এখন গ্রিসে এসেছি। এখানে আমার দীর্ঘ সময় থাকার ইচ্ছা ছিলো। এই প্রাচীন আলোর নগরীটি আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি ক্লান্ত। টানা ছয় মাস ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বিধ্বস্ত। ডাক্তার সাহেব বিশ্রামের হুকুম করেছেন। তাই আমি এথেন্সে থাকতে পারছি না। দেশে ফিরে যাচ্ছি। তবে আমি আবার আসব এথেন্সে। গ্রিসের ডেলফিতে তো একটা বসন্ত উৎসব হয়। আমার অনেক ইচ্ছা সেই উৎসবে যাবার।
সাংবাদিকরা টুকিটাকি প্রশ্ন করে যেতে লাগলো। তারা মুসোলিনীর নিমন্ত্রণের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কবি বুঝলেন, উগ্রবাদী মুসোলিনীর সাথে তার অনুষ্ঠানের খবর এখানেও পৌছে গেছে। কবি ভুল করে ফেলেছেন, সেই একনায়ক শাসকের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে। তারপর যেখানেই যাচ্ছেন, সেই ভুল নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। সব দেশেই কিছু সাংবাদিক আশ্চর্য রকমের বিতর্কজীবি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিতর্ক বের করাই তাদের কাজ। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ইতালীয়ানরা একটা স্লোগান প্রিয় জাতি। ওরা হুজুগে মেতে উঠেছে। একদিন এই হুজুগ থেমে যাবে।
সাংবাদিকদের সাথে প্রশ্নের সময় প্রশান্তচন্দ্র আর রথীন্দ্রনাথ সাহিত্য সমিতির নেতাদের সাথে কথা বলে কবির আজকের দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করলেন। আজ বিকেলেই জাহাজ আবার ছেড়ে যাবে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে।
কবি উত্তর দিয়ে চলছেন। এখনকার বিষয় ইউরোপ বনাম এশিয়া। তিনি বলছেন, ইউরোপ পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্ত অন্তরের সৌন্দর্য পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের মানুষের চেয়ে পূর্বের মানুষের বেশী। এশীয়াতে আলাদা রকম প্রাণ আছে। আমি চাই, পৃথিবীর সব মানুষের আত্মা এশিয়ানদের মত হোক।
একটু হাসলেন রবীন্দ্রনাথ। মনে মনে বললেন, এইতো তোমার লাইনে আসছো। তোমরা যে আমাদের অজ্ঞান ভাবো, সেটা বলতে তোমার সময় লাগল। হেসে কবি বললেন, ইউরোপ শুধু বাইরের দিক দেখে, অন্তরে দেখে না। ইউরোপের শরীর আছে, আত্মা নেই। কিন্তু আত্মা ছাড়া কি শরীর বাঁচে? তাই বিজ্ঞানের যেমন দরকার, অন্তরের উপলব্ধিও দরকার। ইউরোপ সব কিছুকে যান্ত্রিক করে ফেলেছে। ইউরোপ দয়া ও প্রেমের সুন্দর ভাবকে দূর করে দিতে চায়। কিন্তু এই এথেন্স সেরকম না। এখানে একদিন সক্রেটিস, প্লেটোরা অন্তরের আলো খুঁজে বেরিয়েছে। আমি এথেন্সকে ভালোবাসি।
কবি রাজনীতি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর করলেন না। শুধু বললেন, আমি তো কবি, রাজনীতি বুঝি না।
সাংবাদিকরা তবু ছাড়ে না। তারা মহাত্মা গান্ধীর কথা জিজ্ঞেস করলো। গান্ধীর আন্দোলনের খবর এই সুদূর গ্রীসের মানুষরাও রাখে। কবি বললেন, গান্ধী আর আমি এক দেশের লোক কিন্তু আমরা এক মানুষ নই। তিনি রাজনীতির লোক, আর আমি কবি। রাজনীতির কথা আমার মাথায় বেশীক্ষণ থাকে না।
– আপনি গ্রিস নিয়ে কী ভাবেন?
কবি যেন এই প্রশ্নটার আশায়ই ছিলেন। তিনি জানতেন এই প্রশ্ন আসবেই। তিনি বললেন, আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই – একটা প্রাচীন নগর এথেন্স, এখানের রাজপথে অনেক মহৎ মানুষ হাঁটছে। তারা নিজেকে জানার কথা বলেছে, ভালো জীবনের কথা বলেছে। তারা শহর জুড়ে সুন্দর বড় বড় মূর্তি আর মন্দির করেছে। গ্রিসের নাটক-ট্রাজেডির কথাই ধরো। কী চমৎকার সৃষ্টি। আমি গ্রিক নাট্টকার এস্কিলাস আর লোকিয়ানুসকে অনেক পছন্দ করি। এস্কিলাস বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখেছি আর লোকিয়ানুস বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখিনি, কারণ ঈশ্বর নিজেই তাকে কখনও দেখেনি। এস্কিয়াস জীবন গড়তে চেয়েছে, আর লোকিয়ানুস ধ্বংসকামী।
একজন জিজ্ঞেস করলো, আর সফোক্লিস?
কবি বললেন, তিনি উপরের দুই জনের মত অতো উঁচু নয়। কিন্তু আরেক নাট্টকার ইউরিপিডিস ছিলেন যুক্তিবাদী। তবে তার যুক্তি ছিলো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে।
ততক্ষণে জাহাজের সিঁড়ি লেগে গেছে। মানুষ নামতে উঠতে শুরু করেছে। কোথা থেকে যেন আর এক ঝাঁক মানুষ ছুটে এলো ডাইনিং হলে। তারা হতাশ হয়েছে, তাদের আগেই আর একদল আগেই কবির সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেলছে। তারাও যোগ দিলো। কেউ কেউ কবির স্কেচ আঁকা শুরু করলো।
এতো ভীড়ে ক্লান্ত কবির তখন হাঁসফাঁশ করছেন।
এবার প্রশান্তচন্দ্র এগিয়ে এলেন। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, জাহাজ থেকে নামার সময় হয়েছে। এবার কবিকে একটু সময় দিন। আমরা তৈরি হয়ে আসি।
৩.
কিছুক্ষণ পরে কবি তার সেই ট্রেডমার্ক কালো গাউন আর টুপি পড়ে বাইরে এলেন। জাহাজেই উপরেই একবার ফটোসেশান হলো।
কবি জাহাজ থেকে বের হলেন, তখন ঘড়িতে সকাল ৯ টা। এথেন্সের মাটিতে পা রেখেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। যেখানে একদিন সক্রেটিস, প্লেটো, হিরোডোটাস, পেরিক্লিসরা হেঁটেছেন, সেই মাটিতে তিনি দাঁড়িয়ে। কবির ভীষণ ভালো লাগলো। জাহাজের বাইরে অনেক মানুষের ভীড়। তাকে এক নজর দেখার জন্য অনেক মানুষ এসেছে পিরাউস বন্দরে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে এথেন্সবাসী। মিষ্টি হেসে হাত নেড়ে তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ির দিকে আগালেন কবি। গাড়িতে তার পাশে বসেছে গ্রিসের কবি ও নাট্টকার প্রেট্রোস হ্যারিস। আপাতত তিনি টুরিস্ট গাইডের কাজ করবেন। এথেন্স ঘুরে দেখাবেন। কিন্তু দেখা গেল, কবিকে এথেন্স দেখানোর চেয়ে তার সাক্ষাৎকার নিতেই হ্যারিসের বেশি আগ্রহ। গাড়ীতেও তিনি নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। তিনি কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি সমাজতন্ত্রী কিনা। কবি ছোট্ট করে জবাব দিলেন, না, আমি সমাজতন্ত্রী নই।
গাড়ি জাপিও নামে একটা জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলো। এখানের আমানিয়ায় রাণীর বাগান। রাস্তার দুই পাশে সুন্দর গাছের সারি। গাইড বললো, টেগোর, সামনেই এথেন্সের অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ১৮৯৬ সালে এখানেই আধুনিক অলিম্পিক শুরু হয়েছে। আপনি দেখবেন এই ঐতিহাসিক স্টেডিয়াম? কবি অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখতে নামলেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, প্লেটোর একাডেমীর জায়গাটা কোথায় ছিলো, সেটা কি জানা গেছে?
গাইড বললো, একটা জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। এখনো নিশ্চিত হয়নি ওটাই কিনা।
কবি চোখ বন্ধ করলেন। প্লেটোকে তিনি অনেক সম্মান করেন। প্লেটোর প্রতিটি রচনা কাব্যমাখা, প্রতিটি লেখা মায়াময়। কবি সেটি পছন্দ করেন। প্লেটোর একাডেমীর জায়গাটা দেখার ইচ্ছা তার অনেক দিনের। কিন্তু এবার আর সময় হবে না। মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকবেন তিনি এথেন্সে।
গাড়ি এগিয়ে চললো। কয়েকটা আঁকাবাঁকা সরু পথ পার হয়ে একটা পাহাড়ের ঢালুতে গিয়ে থামলো।
গাইড বললো, আমরা এসে গেছি, এটাই এথেন্সের এক্রোপলিস, প্রাচীন নগরটির প্রাণকেন্দ্র। কবি মাথা উঁচু করে তাকালেন সামনের পাহাড়টার দিকে। এই পাহাড়টাই এক্রোপোলিস? এর চারপাশেই জন্ম হয়েছে ইউরোপের সত্যিকার আলো? এই ছোট্ট ভূখণ্ডেই একে একে জন্ম নিয়েছিলো দর্শন, গণতন্ত্র, থিয়েটারের মত আধুনিক ইউরোপের গৌরবের সব কীর্তি। কবির অনেক দিনের ইচ্ছা আজ পূরণ হলো। আলোর আঁতুড়ঘরে তিনি পৌঁচেছেন। কবি ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামলেন। এক্রোপলিসের মাটিতে পা দিয়েই আবার রোমাঞ্চ অনুভব হলো। তিনি যেখানে পা দিয়েছেন, সেখানেই হয়তো একদিন প্লেটোকে দর্শনের কথা বলেছিলেন সক্রেটিস। ওই উপরে দেখা যাচ্ছে একটি থিয়েটার। ওই থিয়েটারেই একদিন জন্ম হয়েছিল ইউরোপের অভিনয় শিল্প, গ্রিক ট্রাজেডি ওখানেই অভিনীত হতো।
ওই তো পাহাড়ের উপর সাদা-সাদা ফ্যাকাশে রঙয়ের কটা খুঁটির মত দেখা যাচ্ছে। ওটার ছবিই কবি দেখেছিলেন। ঐ সেই পার্থেনন – দেবী এথিনার মন্দির। একদিন ওই পার্থেননই ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে জমকালো ভবন। এর নকশা আর জৌলুস দিয়েই ইউরোপে স্থাপত্যের ইতিহাসে সৃষ্টি হয় এক নতুন যুগ। কবির অনেক দিনের ইচ্ছা পার্থেনন দেখার।
ইংরেজ কবি শেলী বলেছেন, ‘আমরা সবাই আসলে গ্রীক’।
ইউরোপীয়ানদের জন্য শেলীর কথাটা পুরোপুরি সত্য। আজকের ইউরোপ আসলে প্রাচীন এথেন্সের জ্ঞান-বিজ্ঞানেরই উত্তরসূরি।
একটা গাছের ছায়ায় কবিকে ঘিরে অনেকে দাঁড়িয়েছে। মুখটা বেশ কালো করে সেদিকে এগিয়ে আসলেন প্রশান্তচন্দ্র। বললেন, গুরুদেব, একটা সমস্যা হয়েছে। পায়ে হেঁটে উপরে ওঠা ছাড়া এক্রোপলিসের উপর যাওয়ার কোন উপায় নেই।
কবি বিমর্ষ হয়ে তাকালেন রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবীর দিকে। প্রতিমা দেবী বললেন, বাবা, এই শরীরে কিছুতেই হেঁটে পাহাড়ে ওঠা যাবে না। ডাক্তার আপনাকে পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে বলেছেন।
এই প্রতীমাই কবিকে একটু শাসন করতে পারে। সারা জীবনে কোন নারীই কবিকে শাসন করে নি। মা না, বৌদি না, মৃনালিনী না – কেউই না। বুড়ো রবীন্দ্রনাথকে যা একটু শাসন করার এই প্রতিমাই করেন। কবি বললেন, ঠিক আছে, মনে হয় দেবী এথিনা চাইছেন না, আমি তার মন্দির দেখি।
রথী বললেন, হুম বাবা, আমরা অন্য কিছুর প্রোগ্রাম করি।
কবি বললেন, না না। রথী। সে কী! সামনে আসা সুযোগ পায়ে ঠেলতে নেই। তোমরা পার্থেনন দেখে আসো। আমাদেরকে পার্থেনন দেখাবে বলে গ্রিসের এতোজন কবি-সাহিত্যিক এখানে এসেছেন। আমি বুড়ো মানুষ উঠতে পারছি না। এখন তোমরাই এই কবি-সাহিত্যিকদের মান রাখো। যাও, সবাই পার্থেনন দেখে এসো।
সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। প্রশান্তচন্দ্র বললেন, গুরুদেব, আমি আর রাণী তো আরো কদিন এথেন্সে আছি। আগামী সপ্তাহে এখান থেকে লন্ডনের জাহাজ ধরবো। আমরা আপনার সাথে থাকি। অন্য সবাই উপরে যাক।
কবি একটু ভেবে বললেন, তাহলে তুমি আমার সাথে থাকো। রাণীকে প্রতিমার সাথে দিয়ে দাও। না হলে, প্রতিমা বেচারী একা হয়ে যাবে।
তাই হলো। কবির হাতে এখন হঠাৎ করেই একটু অবসর। এক্রোপলিসের লাগোয়া একটা ঢালু রাস্তা চলে গেছে আগোরার দিকে। এটি এথেন্সের প্রাচীন বাজার। এখানেই একদিন গণতন্ত্র, আদালত এসবের জন্ম হয়েছিলো। কবি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেই আগোরার দিকে।
হঠাৎ এক তরুন পেছনে থেকে সামনে এসে বললো, ‘দ্যা গ্রেট টেগোর, আমি একজন চিত্রশিল্পী। আমার নাম ভিনকো ফন পেসকো। আমার জন্ম জার্মানিতে কিন্তু আমি ভালোবাসি এথেন্সকে। এখানেই থাকি। ওই সামনেই আমার স্টুডিও। ওখানকার নাম আনাফিওটিকা। সত্যিকার প্রাচীনকে এথেন্সকে দেখতে হলে আপনাকে ওখানে যেতে হবে। এথেন্সের সব কিছু বদলে গেছে, শুধু ওই আনাফিওটিকা গলিটাই সেই আগের মত আছে। ওটাই সেই সক্রেটিসের সময়ের এথেন্স। হেরোডোটাসও নাকি এথেন্সে এলে এখানেই থাকতেন। আমি নিমন্ত্রণ করছি কবি, এই অবসরটুকু আমার স্টুডিওতে কাটান, প্লিস।
কবি মৃদু হেসে যুবকটির দিকে তাকালেন। সাহস আর বুদ্ধি দুটোই আছে এই শিল্পীর। সুযোগ বুঝে ঠিক সামনে এসে গেছে। কবিকে নিশ্চুপ দেখে ভিনকো ফন একটা স্কেচ বের করলেন, দেখুন, টেগোর, জাহাজে দাঁড়িয়ে আমি আপনার স্কেচ করেছি। আর একটু সময় পেলে ছবিটা শেষ করে আপনাকে দেখাতে পারব।
এবার কবি আসল রহস্য বুঝলেন। তাও রাজি হলেন ভিনকো ফন পেশকোর স্টুডিওতে যেতে। চিত্র শিল্পীদের প্রতি ইদানিং তার মন বেশ নরম। তিনি নিজে এই বুড়ো বয়সে ছবি আঁকতে শুরু করেছেন। আর্জেন্টিনার কবি ওকাম্পো নাকি তার হৃদয়ে চিত্রকলা গেঁথে দিয়েছে। সেই চিত্র এখন বুড়ো হাতে যৌবনের আনন্দে বের হচ্ছে। এখন এই তরুণ শিল্পীর কথায় এথেন্সের চিত্রকলা দেখার সুযোগ আসায় কবি মনে মনে খুশিই হলেন।
আনাফিওটিকার সরু গলিতে ঢুকে বুঝলেন, শিল্পী মিথ্যে বলে নি। আসলেই এখানে একটা প্রাচীন গন্ধ আছে। বাড়ি ঘর সক্রেটিসের সময়ের না হলেও কয়েকশ বছরের যে পুরুনো তাতে সন্দেহ নেই। স্টুডিওতে ঢুকে মাচার মত একটা গদিতে বসলেন কবি। এই মাচাটিও সেই প্রাচীন গ্রিসের বসার মাচার মত করেই বানানো। শিল্পী কবিকে গ্রিক পিঠা খেতে দিলেন। কবি খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে এথেন্সের চিত্রকলা দেখছেন আর শিল্পী কবির স্কেচ আঁকছে। এমন সৌভাগ্যের দিন ভিনকো ফনের জীবনে আর আসেনি। সে তন্ময় হয়ে কবির ছবি আঁকছে।
কিছুক্ষণ পরে রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা সবাই সেখানে উপস্থিত হলো। শিল্পীও তার আঁকা শেষ করে ফেলেছে।
তারা স্টুডিও থেক বের হলেন। স্টুডিওর পাশে বিশাল বিশাল মাটির পাত্র। অত বড়ো মাটির মাত্র বাংলাদেশে দেখা যায় না। শিল্পী ভিনকো বললেন, এগুলো সেই প্রাচীনকালের। সেই সময় মৃৎশিল্পে এথেন্স ছিলো পৃথিবী সেরা। সারা দুনিয়ায় বিক্রি হতো এথেন্সের মাটির পাত্র। এগুলো সেই প্রাচীনকাল থেকেই এখানে আছে।
কবি ভালো করে একটা পাত্র দেখলেন। তারপর আপনমনে বললেন, ‘মাটির বাসন, আহা, একবার ভেঙে গেলে, আর কি জোড়া লয়!’ অনেকেই কবির এই কথার উত্তর দিলেন। কিন্তু প্রশান্তচন্দ্র নিশ্চুপ। তিনি কবির দিকে তাকালেন। তিনি জানেন কবির এই কথা সামান্য প্রশ্নমাত্র নয়। নিগুঢ় রহস্যঘেরা এই উক্তি। কিন্তু এই গুঢ় জিনিস বোঝার মত মন বা সময় এই মুহূর্তে এখানের কারো নেই। শুধু প্রশান্তচন্দ্র ভাবতে লাগলেন, মাটির পাত্র বলতে কবি কি বুঝালেন – মানুষের দেহ নাকি মানুষের সম্মান? অসুস্থ কবি কি নিজেকে জোড়া দেবার কথাই বললেন? নাকি মুসোলিনীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করায় তিনি যে অনেকের কাছে সম্মান হারিয়েছেন, সেই কথা বললেন!
৪.
গাড়ী এসে থামলো এথেন্সের সবচেয়ে বড়ো হোটেলের সামনে। নাম গ্রেট ব্রিটেন হোটেল। গ্রিকরা তাদের ভাষায় বলে হোটেল গ্রান্ড ব্রিটানিয়া। গত রাত্রে রবীন্দ্রনাথের এখানে থাকার কথা ছিলো। তার সম্মানে ডিনারের আয়োজনও করেছিলেন গ্রিসের সাহিত্য পরিষদ। কিন্তু গতকাল জাহাজ না আসায় সেসব প্রোগ্রাম ভেস্তে গেছে। আজ আবার এখানেই কবির সম্মানে লাঞ্চের আয়োজন করেছে তারা। লাঞ্চের জন্যও বেশী সময় হাতে নেই। বিকেল সাড়ে চায়টায় এথেন্স থেকে জাহাজ ছেড়ে দিবে। তার আগেই সব কিছু শেষ করতে হবে।
হোটেলের কক্ষে গিয়ে জ্বানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন কবি। আরে, ঐ তো এক্রোপোলিস, এখান থেকে পার্থেনন একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়। হোটেলের ম্যানেজার বললেন, গ্রেট টেগোর, আপনি যাতে রুমে বসেই পার্থেনন দেখতে পান, সেজন্য এই বিশেষ স্যুইট আমরা রেখে দিয়েছি। এখান থেকে পুরো এথেন্স শহর দেখা যায়।
কবি দেখলেন সত্যিই তাই। ভীষণ খুশি হলেন তিনি। সামনে থেকে পার্থেনন না দেখতে পাবার দুঃখ ঘুচে গেলো। ছোট্ট নাতনী নন্দিনীকে জ্বানালা দিয়ে পার্থেনন দেখাতেই সে হেসে কুটিকুটি। এই শিশুরটির হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখছেন কবি। মনে হচ্ছে শিশুটি হাসি দিয়ে এথেন্সকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কবি আবার কলম হাতে নিলেন। লিখলেন,
‘যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে,
দু হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে।’
না, বেশীক্ষণ লিখা যাবে না। লাঞ্চের সময় হয়ে যাচ্ছে, সবাই অপেক্ষা করছে।
অল্প সময়ের মধ্যেই কবি উপস্থিত হলেন হোটেলের বলরুমে। লাঞ্চে আমন্ত্রিত অতিথিরা সমাগত। এথেন্সের লেখক সমিতির সভাপতি নিকোস লাসকারিস কবিকে স্বাগত জানালেন। হলঘরে যারা উপস্থিত তাদের বেশিরভাগই সাহিত্যিক, সাংবাদিক। অনেক শিক্ষকও আছেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে গ্রিস সরকারের লোকজন খুবই কম। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসার কথা ছিলো। কিন্তু তিনি এখনো এসে পৌঁছেন নি। তার নাকি জার্মান দূতাবাসে আর একটি নিমন্ত্রণ আছে। সেটি শেষ না করে তিনি আসতে পারছেন না। এথেন্সের মেয়রেরও নাকি অন্য কাজ আছে। সরকারি লোকজনের এমন উদাসীনতায় বড় অস্বস্তিতে পড়েছেন গ্রিসের সাহিত্য সমিতি। তারা এই লাঞ্চের আয়োজক। টেগোর কী মনে করছেন তাদের!
সাহিত্য সমিতির সভাপতি এসে কবিকে বললেন, সরকারী উদাসীনতায় তারা লজ্জিত। আসলে গ্রিসের রাজনীতি এখন একেবারেই লেজেগোবরে অবস্থা। নেতা-নেত্রীদের নিজেদের অবস্থাই বেসামাল। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কারোই নিজের গদির পোক্ত নয়। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সংসদের নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে কোন দলই সরকার গঠনের মত আসন পায়নি। নেতারা কোয়ালিশন বানাতে রাত-দিন ছুটাছুটি করছেন। আর ক্ষমতায় থাকা মিলিটারি কেয়ারটেকার সরকারও গদি ছাড়ার আয়োজন করছে।
কিন্তু কবি এই আলোচনা আর আগাতে দিলেন না। মন্ত্রী, মেয়রদের জন্য তার কোন আফসোস নেই। এবছর ইউরোপের যেখানেই গেছেন, সব রাষ্ট্রনেতারা ছুটে এসেছেন। নেতাদের উপস্থিতি তার জন্য তেমন বড় কিছু না। তিনি গ্রীক কবি কস্টিস পালামার জিজ্ঞেস করলেন।
কবি কস্টিস পালামা অলিম্পিক সংগীতের রচয়িতা। তিনি টেগোরের একজন বিশেষ অনুরাগী। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেন। বেশ কয়েকবার তাকে এথেন্স ভ্রমণের নিমন্ত্রণ করেছিলেন কস্টিস পালামা। তাকে না দেখে কবি বিস্মিত হলেন। নিকোস সাহেব বললেন, কবি কস্টিস পালামা এখন এথেন্সের বাইরে আছেন। এই মুহূর্তে এথেন্সে না আসতে পেরে তিনি খুবই আফসোস করেছেন। সেই কথা জানিয়ে তিনি টেগোরকে নাকি চিঠিও লিখেছেন।
লাঞ্চে কবির জন্য গ্রিসের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার আয়োজন করা হয়েছে। সুভলাকি, গ্রীক চিজ, অলিভ অয়েল, আঙুর এসবের সাথে কিছু বাংগালী খাবার আর ইতালিয়ান পাস্তা আছে। কিন্তু ডাক্তারের কথা মেনে কবি তেমন কিছু নিলেন না। গ্রিক মধু আর অলিভ অয়েল চেখে দেখলেন তিনি। লাঞ্চ শেষ হলে সভাপতি নিকোস লাসকারিস কবিকে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন। কবি তাদের আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, আমি আবার আপনাদের মাঝে আসতে চাই। এবার এথেন্স দেখে তো সাধ মিটলো না। পরের বার সময় নিয়ে আসবো।
এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর কবি ও প্রোফেসর সিমস মেননড্রস বললেন, দ্যা গ্রেট টেগোর, আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, আমরা কতো খুশি। আপনি জানেন না – আপনি আসলে দেখতে সফোক্লিসের মত। আমার মনে হচ্ছে, আমার সামনে সফোক্লিস বসে আছে। আপনার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মধুর। যতবার শুনি আরো শুনতে মন চায়। আপনার কবিতা কিন্তু আমরা গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করেছি।
তিনি কবির কাছে কিছু লেখা এগিয়ে দিলেন।
কবি দেখলেন গ্রিক ভাষায় তার কবিতার অনুবাদ। গ্রিক ভাষা তো জানা নেই, লেখার উপর হাত বুলিয়ে বললেন, বাহ, খুবই ভালো লাগলো। আপনাদের প্রচেষ্টাকে অভিবাদন জানাই।
এরপর গ্রীসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি এগিয়ে এলেন। প্রোফেসর সিমস মেননড্রসের হাতে একটি চামড়ার বাক্স এগিয়ে দিলেন। বাক্সের মধ্যে কবির জন্য গ্রীসের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক – ‘কমান্ডার অফ দ্যা অর্ডার অফ দ্যা রিডিমার’। প্রোফেসর মেননড্রস সেদেশের রাষ্ট্রপতির পক্ষ হতে কবির হাতে তুলে দিলেন সেই পদক। ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি চুপিচুপি বললেন, আপনি তো আমাদের এখানের রাজনৈতিক অবস্থা জানেন। এক বিশৃঙ্খল সময়ে আপনি গ্রীসে এসেছেন। এই প্রতিকূল সময়েই গ্রিসের রাষ্ট্রপতি দেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি বাছাই করেছিলেন আপনার জন্য। কথা ছিলো – গতকাল রাষ্ট্রপতি নিজেই তুলে দেবেন। কিন্তু জাহাজ এক দিন দেরীতে আসায় সেই আয়োজন বাতিল করতে হলো। তাই আমার উপর ভার পড়েছে, আপনার হাতে পদকটি তুলে দেবার।
রবীন্দ্রনাথের কাছে অবশ্য এটা তেমন কোন বিষয়ই না। তিনি তো গ্রীসের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করার জন্য এথেন্সে আসেন নি। তিনি চেয়েছেন সক্রেটিসের দেশটা একবার দেখতে, প্লেটোর জন্মভূমিটিকে একবার ছুঁতে চেয়েছিলেন। যে এথেন্সের মাটিতে একদিন গণতন্ত্র জন্ম নিয়েছে, যে পাহাড়ের চূড়ায় গ্রিক ট্রাজেডি ভূমিষ্ট হয়েছে, যে নগরের গলিতে দর্শন তার প্রথম পাখনা মেলেছে – সে নগরীটিকে একবার স্পর্শ করতে চেয়েছেন কবি। কতো শত রাষ্ট্রপতি যুগে যুগে কতো কতো কবিকে পুরস্কার দিয়েছে, সে সব পুরস্কার ধুয়ে গেছে কালস্রোতে। তিনি প্রোফেসরসহ সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন।
সাড়ে চারটা বাজতে আর বেশি দেরী নেই। কবির গাড়ি ছুটে চললো পিরাউস বন্দরের দিকে। তাকে বিদায় জানাতে সাথে চললো অনেক কবি সাহিত্যিক।
৫.
জাহাজে ওঠার আগে আবার ঘিরে ধরলো সাংবাদিকরা। কবি বললেন, সেই ছোট বেলা থেকে গ্রিস নিয়ে এতো পড়েছি যে, কয়েক ঘণ্টা এখানে থাকতে পেরেই অনেক ভাল লাগছে। এতো অল্প সময়ে তো তেমন কিছু জানা যায় না। তাই আমার সেক্রেটারি ও বন্ধু প্রশান্ত মহলানবিশ ও তার স্ত্রী এখানে রয়ে গেলো। ওরা আমাকে আপনাদের কথা বলবে।
কবি বিদায় নিয়ে জাহাজে ওঠলেন। প্রশান্ত মহলানবিশ ও রাণীর দিকে তাকিয়ে কবির অন্তর ব্যথায় ভরে উঠলো। গত ছয় মাস প্রতি মুহূর্তে ওরা দুজন কবির পাশে ছিলো। সব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন। বিদায় মুহূর্তে সবার চোখই ছলছল করে উঠলো। কবি তাদেরকে চিঠি লিখতে বললেন।
জাহাজে ওঠেও সাংবাদিকরা পিছু ছাড়ে নি। কবি বলে চলেছেন, আহা, এই যে সামনের দৃশ্য কত সুন্দর। এই সুন্দর দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলবো না। এখানে আকাশ কেমন মুক্ত। এই মুক্ত আকাশে ঈশ্বরকে দেখা যায়।
একথা যখন বলছিলেন, জাহাজে দৌড়ে উঠে এলো চিত্র শিল্পী ভিসকো ফোন পেসকে আর সাথে আর একজন শিল্পী। তাদের দুজনের হাতে রবীন্দ্রনাথের দুইটি স্কেচ। এতক্ষণে তারা আঁকা শেষ করেছেন। কবি স্কেচ দেখে খুশি হলেন। ভিসকো ফন একেবারে মন্দ আঁকেন না। কবি ছবির নিচে স্বাক্ষর করে দিলেন।
জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা নিচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। এক পাশে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রশান্তচন্দ্র আর রাণী। তারা কবিকে প্রণাম জানালেন। কবি সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে এথেন্সকে বিদায় জানালেন। নাতনী নন্দিনীর হাতে ছিলো একটা রুমাল। কবির পাশে দাঁড়িয়ে সেই রুমাল নেড়েই নন্দিনী বিদায় জানাচ্ছে এথেন্সকে। জাহাজ চলতে শুরু করেছে। এথেন্স ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, একটি ছোট্ট নৌকা জাহাজের দিকে দ্রুত ছুটে আসছে। নৌকা থেকে একজন লোক জাহাজের নাবিকের সাথে কথা বলছে। নাবিকটি একটি রশি ফেললো নৌকার দিকে। সেই রশিতে বেঁধে একটি প্যাকেট জাহাজে ওঠে এলো। নাবিকটি দৌড়ে কবির কেবিনে এসে সেই প্যাকেট পৌছে দিলো। কবির জন্য উপহার। ভেতরে একটি পত্রিকা ‘ভ্রাদিনি’। পত্রিকায় কবির ছবি। এথেন্স ভ্রমণের ছবি। বুঝা যাচ্ছে তার এথেন্স ভ্রমণের খবর দিয়েছে এই পত্রিকায়। আর সেই পত্রিকার কপি পৌঁছে দিতে স্বয়ং সম্পাদক সাহেব ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু একটু দেরী হয়ে গেছে, জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। তাই নৌকায় করে জাহাজে এসে পৌছে দিলেন কবিকে। নৌকাটি এখনো দেখা যাচ্ছে। কবি সেদিকে হাত নাড়লেন। ধীরে ধীরে জাহাজ অন্য দিকে ঘুরে গেলো। আর দেখা যাচ্ছে না নৌকাটি। জাহাজ ছুটে চলছে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে।
শান্ত সাগরের থেকে চোখ তুলে তীরের পাহাড়ের দিকে তাকালেন কবি। এখনো দেখা যাচ্ছে সুন্দর এথেন্সকে। পাহাড়-সাগর-দ্বীপ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে জ্ঞান প্রসবিনী রাজধানীটি। এখন মনে হচ্ছে – সুন্দর এথেন্স মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে কবির দিকে। কবি খাতা খুললেন। হোটেলে বসে যে গানটা লিখতে শুরু করেছিলেন, সেটি শেষ করতে ইচ্ছে করছে। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন –
‘যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে,
দু হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে॥
যাবার বেলা সহজেরে
যাই যেন মোর প্রণাম সেরে,
সকল পন্থা যেথায় মেলে সেথা দাঁড়াই এসে॥
খুঁজতে যারে হয় না কোথাও চোখ যেন তায় দেখে,
সদাই যে রয় কাছে তারি পরশ যেন ঠেকে।
নিত্য যাহার থাকি কোলে
তারেই যেন যাই গো ব’লে–
এই জীবনে ধন্য হলেম তোমায় ভালোবেসে॥’
// সুজন দেবনাথ
সূত্রঃ
১। গ্রীক পত্রিকা, ‘এলেফথেরোস টিপোস’, ২৪, ২৫ ও ২৬ নভেম্বর ১৯২৬
২। গ্রীক পত্রিকা, ‘এলিনিকি’, ২৫ নভেম্বর ১৯২৬
৩। গ্রীক পত্রিকা, ‘এসটিয়া’, ২৫ নভেম্বর ১৯২৬
৪। ‘ই এলিনিকি তই টেগোর এথিন এলাদা’ গ্রীক ভাষায় (‘রবীন্দ্রনাথের গ্রিস ভ্রমণের ৯০ বছর পূর্তি’) সম্পাদনা ডিমিত্রিওস ভাসিলিয়াদিস, ২০১৬ সালে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৩-৫৪
৫। গ্রীক পত্রিকা, ‘ডেমোক্রতিয়া’, ২৬ নভেম্বর ১৯২৬
৬। গ্রীক পত্রিকা, ‘এমভ্রোস’, ২৬ নভেম্বর ১৯২৬
৭। গ্রীক পত্রিকা, ‘এপোগেভমাতিনি’, ২৬ নভেম্বর ১৯২৬
৮। চিঠিপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা-৫
৯। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১০। পথ ও পথের প্রান্তে (পত্রধারা-৩, ভূমিকা), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও রানী মহলানবিশকে লিখিত কবির পত্রগুচ্ছ)
১১। রবীন্দ্রজীবনী ৩য় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ২৫৬-২৬৬
১২। রবীন্দ্র জীবন – ২য় খণ্ড, আবদুশ শাকুর, পৃষ্ঠা ২৮৮
১৩। কবি-কথা, শ্রীপ্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ
ছবিঃ এথেন্সে রবীন্দ্রনাথ
………………………………………………