রক্ত চুম্বন // অনুপম সরকার
May 2, 2018
তপন দেবনাথ
May 2, 2018

ঋতুশ্রী ঘোষ

বিতুষ্ট বিনিময়

এক.

 

হে ঈশ্বর !

তার প্রখর কামনায় জৈবিকতার জল দিওনা।

তার অনিষ্ট লালসায় জৈবিকতার জল দিওনা।

বৃষ্টিবিহীন বিরহ দিনের মেঘমল্লার এ

শানিত কর তার বিপন্ন অভিসার।

জোছনা বিহীন চাঁদনী রাতের কানড়ায়

পান্ডুর কর তার বিনিদ্র প্রহসন।

স্রোত বিহীন বৈঠার প্রথম সূর্যস্নাত ভৈরবীর

আলিঙ্গনে গ্রাস কর তার বোবা শিরা ধমনী।

হে ঈশ্বর !

তার প্রখর কামনায় জৈবিকতার জল দিওনা।

তারঅনিষ্টলালসায়জৈবিকতারজলদিওনা।

তুমি বরংতাকে

একজনমে একটি বার

আমাতে তার পূর্ণ নিমগ্নতায়

আত্মিকতার বীজ দিও।

 

দুই.

 

ঠিক বলেছ ,

আমি তোমার জন্যই সাজি ,

হে পুরুষ !আমি তোমার জন্যই সাজি ,

আমি তোমার জন্যই বাঁচি,

হে পুরুষ !আমি তোমার জন্যই বাঁচি।

তোমাকে বাঁচাতে আমি বাঁচি ,

তোমাকে রাঙাতে আমি সাজি ,

তোমাকে হাসতে আমি হাসি।

 

বৃথা করোনা চেষ্টা ;

এ বড় দুরূহ ,

এমন উদার ,নির্লিপ্ত – আত্মনিবেদন সম্ভব নয়

তোমারপক্ষে।

পক্ষপাতদুষ্ট ভগবান ,

এ অহংকার শুধু আমাকেই দিয়েছেন

নেশাগ্রস্থ উদার পূর্বাহ্নে।

এই অনন্ত জ্যোতির্ময় প্রকাশ

শুধু আমাকেই সাজে।

সূর্যসম দীপ্তি যার নয়নযুগলে

অতীন্দ্রিয় অত্যুজ্জ্বল মহিমা যার হৃদয় সলিলে

নিদারুণ খেলাচ্ছলেও তার সাথে করোনা

তপ্ত তুষ্ট তীব্র তুলনা।

অভ্রান্ত অসামান্য সংযমী ব্রক্ষ্মচর্যে যার মৌন হাতেখড়ি

তার মগ্ন মায়া দণ্ড যদি ভেঙ্গেই থাকে ,তবে তা ভেঙ্গেছ

স্বরাজ স্বেচ্ছাচারী ম্লেচ্ছাচারী তুমি।

পক্ষপাতদুষ্ট ঈশ্বর আমাতে তোমার পূর্ণ নিমগ্নতায়

আত্মিকতার বিনিময়ে দিয়েছেন জৈবিকতার জল।

 

তিন.

 

তোমার উদ্দেশ্যে বলছি –

“তোমার নিষ্ঠুর নির্লিপ্ত ভালবাসার মাথায় হাত।”

“আমি আন্মানুষমানুষ ”

নীরব নিঃশাস ফেলি অতন্দ্র নিশির আজন্ম আর্দ্রবালিশে।

নিশ্চুপ নির্ভরতার নিশ্চিত নিঃসরণ অপেক্ষা-

নির্লিপ্ত একাগ্র পুরুষ ,তোমার জন্য।

 

একবার এচোখে চেয়ে দেখ-

এচোখ কতোটা কাঙ্গাল ,

কত হা-হুতাশ উচাটনএই চাক্ষুষ চোখে ,

কত হুলস্থুল অনটন এই নিভৃত হৃদয়ে।

আমি তোমার মৌনতা ভঙ্গ করবোনা –

অভয়ারণ্যের বিমূর্ত বিমুগ্ধ কোলাহলে।

 

বরং এক কস্মিনকালের অনুরোধ জানাবো-

তুমি ঠিক বৃত্তের কেন্দ্রে দন্ডায়মানহও এক সত্ত্বায়  ,

অন্য সত্ত্বায় ঠিক বৃত্তের রেখা বরাবর হেঁটে আসো-

নিজেতে অর্ধনিমগ্ন অবস্থায় ,

তৃতীয় সত্ত্বায় বৃত্তের চারিধারে দ্রুত কেটে দাও

এক লোভহীন লক্ষণ গন্ডি।

এবার এক আধ-আবছায়া সত্বায়

লক্ষণ গন্ডি আর বৃত্তের মাঝে টেনে দাও

নিখুঁত সুচাগ্র সুরুক।

আমি বক্ররেখার নিদারুণ সত্বার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে

তাকে দেব প্রাণান্ত বিষ ,

আর সবার অলক্ষ্যে বৃত্তের কেন্দ্রে করব

এক আলেখ্য বসবাস –তোমার আধেক আলিঙ্গনে।

তুমি ,তোমাকে ;

আমার স্বেচ্ছাচারী একাগ্র পুরুষ

বা আধেক বিতুষ্ট নির্লিপ্ত ঈশ্বর

যা খুশি ভাবতে পার।

তবে আমি কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই

তোমার বিনিময়ে আমাকেই চাইব

আত্মিক নিমগ্নতায়।

তুষার রাজকন্যা //

জেসিকার বয়স  সবে মাত্র তিন। কিন্তু ওর কান্ডকারখানা দেখে ওর বাবা-মার্ চেয়েও ওর দাদু -দিদা  বেশি অবাক হয়। ওদের বাড়িতে মোট লোকসংখ্যা ছয় জন। জেসিকা নিজে , ওর বাবা , মা , দাদু ,দিদা আর ঝিমি। না, ঝিমি জেসিকার ভাই বা বোন নয় , ঝিমি হলো জেসিকাদের আদরের তুলতুলে পোষা বিড়াল।

জেসিকাকে ওদের বাড়ির সবাই একটু বেশিই আদর করে। অবশ্য শুধু বাড়ির লোকই নয় , যে ই ওকে দেখে সে ই ওকে আদর করে। মিষ্টি গায়ের রঙের , বড় বড়  গোল গোল চোখের , ফোলা ফোলা গালের দুষ্টু-মিষ্টি বুদ্ধিমতী মেয়ে। যদিও  সব বাড়ির লোকেরাই তাদের নিজেদের বাচ্চাদেরকে খুব বুদ্ধিমতী মনে করে। তবে জেসিকার বুদ্ধি আর দুষ্টুমি সবারই নজর কাড়ে একটু বেশিই  । ও এমনই দুষ্টু যে ও যখন খুব শান্তশিষ্ট থাকে তখনও ওর চোখেমুখে বিদ্যুতের মতো লুকোচুরি খেলে।জেসিকা দেখতে বাবার মতো হলেও সবাই বলে – ও ওর মায়ের মতোই বুদ্ধিমতী । দুই বছর বয়স হতে না হতেই কথা বলতে শুরু করেছিল।

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো – যখন স্নো-ফল হয় তখন  দেখা যায়  জেসিকার সম্পূর্ণ  ভিন্ন এক রূপ। এক্কেবারে ছোট্ট বেলা থেকে , এই ধরো বেশি হলে এক বছর বয়স হবে ওর। তখন থেকেই খুব আগ্রহ নিয়ে স্নো-ফল দেখে ও। একদম চুপচাপ শান্ত মেয়ের মতো। কি দেখে তা ও আর ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানেনা। স্নো পড়া দেখলে ,ও যেন মনে মনে স্নোর মধ্যে হারিয়ে যায় ,ডুবে যায়। যখন বাড়ির বাইরে থাকা অবস্থায় স্নো পড়ে , ওর গায়ে স্নো পড়ে – তখন গ্লাভস পরে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে যেন পরম মমতায় সেগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে।

ওর এই স্নো প্রেম দেখে কেউ বলে – ‘তুষার রাজকন্যা ‘ , কেউ বলে ‘ তুষার  রানী ‘ , কেউ বলে ‘ তুষার প্রেমিকা ‘ , ‘ তুষার কবি ‘, ‘ তুষার বিজ্ঞানী’  আরো কত কি  !  ওর এই তুষার প্রীতি সবার যেন হাসির খোরাক। সেই এক বছর বয়স থেকে প্রত্যেক শীতকালেই কত দিন যে কত ছোট্ট ছোট্ট মজার ঘটনা ঘটেছে জেসিকাকে নিয়ে , তার কোনো গোনা-গুনতি নেই।

জেসিকার বাবা – মা দুজনেই যখন অফিসে যায়।  তখন ও দাদু-দিদার কাছে থাকে। সন্ধ্যার আগেই ওর বাবা-মা  অফিস  থেকে  ফিরে আসে।

এখন শীতকাল।  প্রায় প্রতিদিনই তুষারপাত হচ্ছে।

ওর মন খুব খারাপ। এর আগেও অনেকবার অফিসের কাজে ওর বাবাকে দূরে যেতে হয়েছে।  যে কারণে ওর বাবা কখনো   কখনো রাতে বাড়ি আসতে পারেনি , কখনোবা দু’তিনও বাড়ি আসতে পারেনা। কিন্তু ওর মা কখনো অফিসের কাজে রাতে বাইরে থাকেনি। কিন্তু  সেদিন হঠাৎ ওর মা  অফিস থেকে ফিরে বললো পরের সপ্তাহে দুইদিনের জন্য অফিসের কাজে  বাইরে যেতে হবে। ওই দুইদিন ওকে দাদু-দিদার কাছেই থাকতে হবে। কারণ অফিসের ট্যুরে বাচ্চা নিয়ে যাওয়া যাবেনা।

যা হোক , দেখতে দেখতে সেই দিন চলে এলো। জেসিকার মায়েরও খুব মন খারাপ। এর আগে কখনো মেয়েকে ছেড়ে বাইরে রাত কাটেনি। কিন্তু কিছু করার নেই। সকালে উঠেই জেসিকার দিদা ওকে নিয়ে প্রি-স্কুল এ গেলো।  জেসিকার মা যখন অফিসে গেলো তখন জেসিকা স্কুলে। অবশ্য ও স্কুলে যাওয়ার আগে ওর মা ওকে খুব আদর করেছে। দুষ্টুমি  করতে  মানা করেছে।  মা আসার সময় অনেক খেলনা  আর চকোলেট নিয়ে  আসবে বলেছে। আর বাবা তো থাকছেই , তাই জেসিকারও  খুব বেশি মন খারাপ হয়নি।  তবে ও স্কুলে আসার সময় ওর মা খুব কাঁদছিলো। ওর অবশ্য কোনো কান্না পায়নি। দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ঝিমির সাথে ও আজ অনেকক্ষন খেলেছে। দুপুরে লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে ঘুমও পড়েছে। একবারও মায়ের কথা বলেনি। অবশ্য জেসিকার মনে হচ্ছে আজ যেন দাদু-দিদা অন্যদিনের চেয়ে ওকে একটু বেশিই আদর করছে , দুষ্টুমি করলে রাগও করছেনা। যথারীতি বিকালে ঘুম থেকে উঠে  ও দাদু-দিদার সাথে পার্কে খেলতেও গেছে। খেলা  শেষে বাড়িতে এসে ওর পছন্দ মতো অনেক টিফিনও দিদা করে দিয়েছে।

এই অবধি ভালোই ছিল। কিন্তু গোন্ডগোলটা হলো ঠিক আর একটু পরেই। ওর বাবা যখন সন্ধ্যা হতেই -অফিস শেষে বাসায় এলো , কিন্তু মা এলোনা তখন জেসিকার বুকের মধ্যে হুহু করে উঠলো। নিজের অজান্তেই ওর চোখ দুটো জলে ভরে গেলো। তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু বাবা যখন জেসিকাকে কোলে নিয়ে বসে আদর করতে করতে  দিদাকে বললো –

# মা , একটা সমস্যা হয়ে গেছে। কাল সকালেই অফিসের কাজে আমাকে বাইরে যেতে হবে , ৫ দিনের ট্যুর। পরশু দুপুরে ওর মা চলে আসবে ঠিকই , কিন্তু কাল রাতটা কি তোমরা দুজনে মামকে ( জেসিকার বাবা মেয়েকে আদর করে মাম ডাকে ) সামলাতে পারবে ?

বাবার এই কথা শুনেই জেসিকার মন খারাপ হয়ে গেলো।

# আমি মার্ কাছে যাবো।

ভেউ ভেউ করে মেয়ে কান্না জুড়ে দিল। কোনো কিছু বলেই তিনজন মানুষ শত চেষ্টাতেও মেয়ের কান্না থামাতে পারলোনা। কিছু খাওয়াতেও পারলোনা।  থেকে থেকেই কেঁদে ওঠে। কারণ-অকারণেই কাঁদছে। সারা রাত জেসিকার কান্নার কারণে তিনজনের কেউই  ঘুমাতে  পারলোনা। তখন পূর্ব আকাশে আলো ফুটে  গেছে। সূর্য পুরোপুরি না উঠলেও বাইরে আলোতে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ জেসিকা বাইরে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো –

# বাবা, স্নো।

মেয়ের কান্না থেমে গেলো। দাদুও তাড়াতাড়ি বুদ্ধি করে বললো –

# আমার জুসি সোনা , স্নো দেখতে দেখতে লক্ষী মেয়ের মতো একটু স্নো দুধ খেয়ে নাওতো।  তবে দেখবে আরো স্নো পড়বে। জেসিকা দুধ খেতে রাজি হয়ে গেলো। ঢকঢক করে এক গ্লাস দুধ খেয়ে নিলো। বাবা বুদ্ধি করে বললো –

# আমার মাম এখন বাবার কোলে শুয়ে শুয়ে স্নো দেখবে।

জেসিকা বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেলো। আর সারা দিনের দুরন্তপনা এবং সারা রাতের কান্না – তাই কোলে শুয়ে স্নো দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলো। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচল।

 

পরদিন জেসিকার বাবার ট্যুর ,তাই মেয়ের সাথে সাথে মেয়ের বাবাও একটু ঘুমিয়ে নিলো। কিন্তু দিদা আর দাদুর ঘুম হলোনা। দিদা রান্না করতে গেলো।  আর দাদু দিনের বেলা ঘুমাতে পারেনা , তাই গল্পের বই নিয়ে বসলো। একটু ঘুমিয়ে জেসিকার বাবা উঠে রেডি হয়ে অফিসে চলে  গেলো। মেয়েকে আর ডাকলোনা। আর বলে গেলো ওকে না ডাকতে।  একেতো কাল সারারাত ঘুমায়নি ,আর তাছাড়া যতক্ষণ ঘুমায় ততক্ষনই শান্তি। এমনকি এও বলে গেলো – যদি এমনিতেই ওর ঘুম না ভভাঙে তবে আজ আর স্কুলেও না পাঠাতে। এমনিতেও  আজ আবহাওয়া খুব খারাপ , বাইরে অনেক স্নো পড়ছে।

জেসিকাও ঘুম থেকে অনেক দেরি করে করে উঠলো। ওর উঠতে উঠতে প্রায় এগারোটা বেজে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই জানালার কাছে স্নো দেখতে বসে গেলো।  ওর দাদু- দিদার একটু ভয়ই করছিলো ওকে নিয়ে , কিন্তু ও ঘুম থেকে উঠে একবারের জন্যও বাবা-মার্ কথা বললনা। ওর দাদু-দিদাও যেন একটু স্বস্তি পেলো। দিদা বললে -মিনিটের মধ্যে উঠে দাঁত মেজে, ওয়াশরুমের কাজ সেরে  , ব্রেকফাস্টও করে ফেললো। একটুও বায়না করলোনা। আবার এসে স্নো দেখতে বসলো । এবার দাদুকে বললো –

# আমি স্নো দেখতে বাইরে যাবো।

সারারাত কান্নাকাটি করার কারণে জেসিকার অল্প অল্প সর্দিও হয়েছে । তাই  দাদু ওকে বুঝিয়ে বললো – বাইরের আবহাওয়া খুবই খারাপ , তাছাড়া ওর সর্দি হয়েছে তাই বাইরে যাওয়া ঠিক হবেনা । বরং বিকালে স্নো পড়া বন্ধ হয়ে গেলে ওরা বাইরে যাবে। সারাদিন ও একটুও ঝামেলা করলোনা । বিকালে আবহাওয়া  আরো খারাপ হলো। সারা শহর ২০ সেন্টিমিটার বরফে ঢেকে গেলো। রেড এলার্ট জারি হয়ে গেলো।  বিকালে জেসিকা বাইরে যেতে চাইলো। কিন্তু বাইরের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে দাদু ওকে বাইরে নিয়ে গেলোনা। বললো পরদিন সকালে নিয়ে যাবে। ও নিজে দরজা খুলে দুইবার বাইরে চলে গেলো।  দাদু দৌড়ে গিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে এসে দাদু নিজেই দরোজার সামনে বসে থাকলো ,যাতে করে ও আর বাইরে যেতে না পারে।  জেসিকার খুব মন খারাপ হলো। কিন্তু বাবা-মা বাড়িতে নেই বলে ও একটুও কাঁদলোনা।  শুধু জানালায় বসে বসে স্নো দেখতে লাগলো।

যা হোক , কোনো রকম বিকালটা কেটে গেলো। আজ আর জেসিকা কান্না করলোনা। বাবা-মার্ জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছিলো। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।  ও জানে, ও যদি কান্না করে তবুও মা আজ আসবেনা। কারণ মা অনেক দূরে গেছে। মা যদি আস্তে পারতো তবে কালই ও যখন সারারাত জেগে অনেক কান্না করেছিল তখনই চলে আসত। ও আজ সারাদিন একমনে বসে স্নো দেখলো।  অন্যদিন স্নো দেখার সময় বারবার সবাই এসে ডিসটার্ব করে , কিন্তু আজ কেউ কিচ্ছু বলেনি।  তাই ও একটু খুশিও হয়েছে।  আর তাছাড়া কাল দুপুরেই মা চলে আসবে , তা ও জানে।  তাই হয়তো তেমন মন খারাপ হচ্ছেনা।  কাল সারারাত দাদু-দিদা ঘুমাতে পারেনি। তাই আজ একটু তাড়াতাড়িই  রাতের খাবার শেষ করে ওরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।

 

পরেরদিন জেসিকার অনেক সকালে ঘুম ভেঙে গেলো। বিছানায় শুয়েই জানালা দিয়ে দেখতে পেলো অনেক স্নো পড়ছে। ওর বাইরে যেতে খুব ইচ্ছে করলো। পাশের বিছানায় ঘুমানো দাদু-দিদার দিকে চোখ পড়তেই মনে হলো – কাল দাদু বাইরে নিয়ে যায়নি। বাইরে স্নো পড়ছে দেখলে আজও হয়তো নিয়ে যাবেনা। মনে মনে ও একটা বুদ্ধি বের করলো।  ভাবলো – দাদু -দিদা  এখনো ঘুমিয়ে , ওরা  ঘুম থাকতে থাকতেই বরং ও একাএকা একবার বাইরে গিয়ে স্নো দেখে আসবে। যেই ভাবা ,সেই কাজ।  খুব আস্তে আস্তে ও বিছানা  থেকে নেমে পড়লো। চুপিচুপি শোয়ার ঘর থেকে বের হয়ে বসার ঘরে এলো।  জেসিকা জানে -ও বড় হয়ে গেছে , একাএকা দরজা খুলে বাইরে  যেতে পারে , জুতো ও পড়তে পারে। ও জুতোটা পরে আস্তে আস্তে দরোজার লক খুলে বাইরে বের হওয়ার এলো।  এক দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনের ফুটপাতে চলে এলো। তখন সূর্য ওঠেনি ,বাইরে ভীষণ ঠান্ডা লাগছে ওর।  অনেক বরফ ও জমে গেছে ,প্রায় ওর কোমর সমান। কিন্তু চারিদিকে সাদা আর সাদা , তুলোর মতো স্নো পড়ছে সাদা ফেনার কার্পেটে ,রাস্তায় কেউ নেই , দু’হাতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে নির্মল স্বাধীনতা।  দাদু-দিদা এখনো টের পায়নি যে ও বের হয়ে এসেছে। আর একটু ঘুরে আসার টান জেসিকা আর সামলাতে পারলোনা।  আনন্দে নাচতে নাচতে ফুটপাত ধরে দৌড় দিলো ও।  কিন্তু না ,খুব বেশি দূর এগোতে পারলোনা। ঠান্ডায় সারা শরীর জমে যাচ্ছে ওর।  তখন মনে হলো – তাইতো ও তো উইন্টার জ্যাকেট পরতে ভুলে গেছে , স্নো বুটও পরেনি। কিন্তু ততক্ষনে ঠান্ডায় ওর সারা শরীর জমে আসছে। দৌড়ে বাড়ি পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা আর ওর নেই। কিন্তু ওই কোমর সমান বরফেও ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা।  তখন ও খুব জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো , কিন্তু তবুও কোনো বাড়ির দরজা খুলে কেউ বের হয়ে এলোনা। ও যে বাড়ির সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল ,সেই বাড়ির বাগানের মধ্যে একটা ছোট্ট ঘর দেখতে পেলো , যার দরজাটা খোলা । ওর মনে পড়লো -ঐটা হলো ওর বন্ধু জন দের বাড়ি।  আর ওই ছোট্ট ঘরটা হলো গ্রীষ্ম কালে ওদের খেলার ঘর ,ওই সময় জনের ডগি নিক ও ওই ঘরটার মধ্যে থাকে। জেসিকা কাঁদতে কাঁদতে জন কেও ডাকলো।  কিন্তু জনরাও তখন ঘুমাচ্ছে ,কেউ ওর ডাক বা কান্না কিছুই শুনতে পেলোনা। জেসিকা অনেক কষ্টে ওই ঘরটার মধ্যে ঢুকে গেলো। কিন্তু ওই ঘরটাতেও একটুও গরম নেই , তবে অবশ্য বরফ নেই। কিন্তু জেসিকা নিজেই বরফে ঢাকা , ওই বরফ যে ঝেড়ে ফেলা যায় তা ওর বুদ্ধিতে এলোনা।  কিন্তু ঘরটার মধ্যে ও একটা চাদর পেলো যেটা কিনা নিক এর।  ও ওই চাদরটা গায়ে দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে মা কে ডাকতে লাগলো। কিন্তু ওর গলা থেকে তখন আর একটুও স্বর বের হচ্ছেনা।

একটু পরে ও আর কাঁদতেও পারছিলোনা। ও বুঝতে পারছে – ওর ঘুম পাচ্ছেনা , কষ্ট হচ্ছে , কিন্তু ও যেন কোথায় চলে যাচ্ছে , আর কিছুই যেন টের পাচ্ছেনা। ও কি তবে স্নো রাজ্যের রাজকন্যা হয়ে যাচ্ছে …..

অন্টারিও, কানাডা