সোহেল হাতমুখ ধুয়ে এসে রুটির প্যাকেটটা হাতে নিতেই দরজা খুলে জামাল ঢুকল।
“কিছু পেলি?”
“না।”
গত ক’মাস ধরে কথাবার্তা এ ধরনেরই। ওদের ৬ জনের মধ্যে ৫ জনের কাজ নেই। জামালের একার আয়ে ৬ জন কোনরকমে আপাতত আছে এই ঘরটাতে। ঘর বলতে একটা কারখানার মেশিন রুমের পাশে একটু জায়গা। জামালের একার থাকার কথা। মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ৬ জন আছে। সবাই ঘরে থাকলে জায়গার অভাবে দু’জনকে বসে ঘুমাতে হয়। সেই ভোরে বেরিয়ে যায়, এখানে লাইনে দাঁড়ায়, ওখানে একগাদা কাগজ লিখে জমা দেয়, কিন্তু কাজ আর হয় না। ভাষাটা জানা থাকলেও হয়ত কিছুটা আশা ছিল। প্রতিদিন নিরাশ হয়ে ক্লান্ত শরীরে ফেরা। তারপর ৮ খানা পাউরুটি ৬ জনে ভাগ করে খাওয়া।
“বাইরে থেকে পানি নিয়ে আয়। খিচুড়ি বসাব।”
“বলো কি! চাল-ডাল কোথায় পেলে?” সোহেল অবাক। ওরা ভাত খেয়েছে প্রায় মাস খানেক আগে। ডাল কবে খেয়েছে মনে নেই। এদেশের অদ্ভুত খাবার মুখে রোচে না, তাই রুটি খেয়েই দিনের পর দিন পার করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-আধটা কলা।
“ভাবিস না, চুরি করিনি।” হেসে বলল জামাল। “না খেয়ে খেয়ে তোদের একেকজনের চেহারা যা হচ্ছে, বাড়ীতে গেলে মুখ দেখাবি কি করে? বৌ পাবি কই?”
সোহেলের চোখে জল এসে গেল। জামাল ওদের এলাকার ছেলে, কিন্তু দেশে থাকতে পরিচয় ছিল না। এখানে আসার পর আরেকজনের মাধ্যমে পরিচয় হয়। জামাল যখন প্রথম আসে, তখন তার বয়স সোহেলের চেয়েও কম ছিল। বাবা ছিল না, মা অসুস্থ। পড়াশুনা করার ইচ্ছা ছিল, হয়নি। ভাইবোন আছে, দায়িত্ব আছে। হঠাৎ করেই বিদেশ যাওয়া ঠিক হল। জমি বেচে, মায়ের টুকটাক গয়না যা ছিল সব বিক্রি করে পয়সা জোগাড় হল। দেশ ছাড়ার সপ্তা’ খানেক আগে মা বেঁকে বসলেন। দূর দেশে যেতে হলে বিয়ে করে যেতে হবে। দু’দিনের মধ্যে সম্বন্ধও ঠিক হল। বিদেশ যাওয়া ছেলে, কে হাতছাড়া করবে! বৌটার মুখ ভাল করে দেখার আগেই দেশ ছাড়তে হল। কথা ছিল ছ’মাসের মধ্যে বৌকে নিয়ে যাবে। অথচ নানা দেশ, নানা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতেই চার মাস কেটে গেল। দেশে যোগাযোগ হল প্রায় এক বছর পরে। মা কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, বৌকে তার বাবা-মা নিয়ে গেছে।
“হলুদ নেই। শুধু লবণ দিয়ে রাঁধব। আমার মামাবাড়ীর দিকে খিচুড়ি সাদাই খায়। বসে বসে কি দেখছিস? এসে হাত লাগা!”
গত দশ বছরে খেয়ে না খেয়ে জামাল দেশে ভাইবোনগুলোর পড়ার খরচ যুগিয়েছে। মাকে বাঁচাতে পারেনি, দেশ ছাড়ার দু’বছরের মাথায় মা মারা গেছেন। একবার দেশে ফিরবে ভেবেছিল, কিন্তু যখন শুনল ওদের পাশের এলাকাতেই ওর বৌকে আবার বিয়ে দেয়া হয়েছে, ও যাওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলল। ঠিক করল যতদিন অনেক অনেক টাকা না জমে, দেশে ফিরবে না।
সেই অনেক অনেক টাকা আর জমানো হয় না জামালের। দেশে ভাইবোনদের পড়ার খরচ বেড়েই চলেছে। দু’একজনের বিয়ের বয়স হয়েছে। তার ওপর ঘরে সবসময় কয়েকজন করে আশ্রয় নিয়ে আছে। কেউ কষ্টে আছে জানলে জামাল চুপ করে থাকতে পারে না। সাথে করে নিয়ে আসে। এভাবেই সোহেল ও বাকীরা এখানে আছে। চাকরি পেয়ে চলে যাবার আগে কেউ কেউ কিছু টাকা ধরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু জামাল নেয় না।
“চুলোর গ্যাস প্রায় শেষ দিকে রে… যদি রান্না শেষ হওয়ার আগেই আগুন নিভে যায়?”
“আগুন নিভে গেলে চাল-ডাল কাঁচাই খাবো জামাল ভাই। তুমি রেঁধে দিলে সব খেতে পারি।” সোহেলের চোখের জল গড়িয়ে পরল, আর আটকাতে পারল না।
“আবার কি হল?”
“কিছু না জামাল ভাই। তোমার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না।”
জামাল আবার হাসল। আঁচটা একটু কমিয়ে দিয়ে বলল, “সোহেল রে— আজকের মত খা। আজকের মত বাঁচ। দেখবি, কাল একটা কিছু হবে।”
সোহেল ঝাপ্সা চোখে টিমটিমে আগুনটার দিকে চেয়ে রইল। একটু একটু করে হলেও ঠিক জ্বলছে, নিভে যায় নি।