(গল্পের প্লটটা একটা ফরাসী লেখা থেকে নেয়া। একই জায়গা থেকে ধার করে শিবরাম চক্রবর্তীও এই গল্প বলেছেন। তবে আমি তাদের মত করে না আমার মত করে গল্পটা বলেছি)
মাত্র ক’দিন হল পাভেল এ’দেশে এসেছে। এখনো ক্লাস শুরু হয় নি তাই ক্যাম্পাস বেশ ফাঁকা ফাঁকা! বিদেশী ছাত্র বলে ক্লাস শুরু হওয়ার বারো দিন আগেই ওকে ডর্ম রুমে ঢুকতে দেয়া হয়েছে। ওর চোখে ফুটে ওঠা প্রশ্নটা বুঝতে পেরে রেসিডেন্ট এসিস্টেন্ট বলল, এদেশীরা ক্লাস শুরু হওয়ার আগের উইকেন্ডে এসে ডর্মে আবাস গাড়ে। আগে থেকে এখানে এসে থাকার ওদের কোন সুযোগ নেই। তা, ক্লাস শুরু হতে এখনো গুনে গুনে আরো আট দিন বাকি। পাভেল আড্ডাবাজ ছেলে। এই নির্জন ডর্মে একটাও কথা বলার মানুষ নেই। কালে ভদ্রে RA এর সাথে দেখা হলেও কথা বার্তা হাই হ্যালো’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। লাউঞ্জটাও ওর রুম থেকে বেশ দূরে। সেখানে গেলে বসে টিভি দেখা যায়। কিন্তু এই ক’টা দিন শুধু টিভি দেখতে দেখতে ওটাও ভীষন একঘেয়ে হয়ে গেছে। অগত্যা, মোটামুটি শুয়ে বসেই অলস এই দিনগুলি কাটাতে হচ্ছে। সকাল থেকে আজও তাই; চোখদুটোর ওপরে কপালটা আড়াআড়ি দুই হাতে ঢেকে সিলিংএর দিকে নিস্পলক চেয়ে শুয়ে ছিল। আচমকা একটা আইডিয়া মাথায় আসতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। এই ক’দিনে সারাটা ক্যাম্পাসের সমস্ত আনাচ কানাচ ভালমতো এক্সপ্লোর করা হয়ে গেছে। আজ উল্টো দিকে হাটা দিলে কেমন হয়? উল্টো দিক মানে ক্যাম্পাসের পশ্চিমে, যেদিকে রয়েছে শুধু ঘন গাছের সারিতে ঢাকা একটা সড়ক, গাছগুলোর দু’পাশে ভুট্টার ক্ষেত। রাস্তাটা টানা মাইলের পর মাইল চলে গিয়েছে। ওর পাঁচ তালার রুমের জানালা দিয়ে যতদুর দেখা যায় তাতে মনে হয় ভুট্টা ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে কিছু ঘরবাড়িও রয়েছ। পাভেল ভাবলো, রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আসে সত্যি ওসবে জনমানুষ বসবাস করে কিনা। ভারি জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে, হাতে গ্লাভস আর পায়ে নুতন কেনা স্নিকারটা পড়ে ও যখন ডর্মের লবিতে এসে দাঁড়ালো, তখন প্রায় আড়াইটা বাজে। জানুয়ারীর শুরুতে এই সময় সন্ধ্যা হয় সাড়ে চারটার দিকে। এদেশে আসার পর এও আরেক অদ্ভুত নুতন অভিজ্ঞতা। ভর দুপুরের আমেজটা পুরোপুরি কাটার আগেই হঠাত ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। তবে সেই সন্ধ্যে হতে হাতে এখনো ঘন্টা দুয়েক সময়। আজ আকাশটা কেমন মেঘলা। বৃষ্টি আসবে নাকি? দূর! এতো ভেবে কাজ নেই, সোজা কিছুক্ষন হেটে তারপর সময়মত যদি ঘুরে ফেরা শুরু করে তাহলে অন্ধকার নামার আগেই ডর্মে ফিরে আসতে পারবে। বৃষ্টি নিয়ে ওর তেমন একটা মাথাব্যথা হল না। যদিও বেজায় ঠান্ডা, খানিকটা ভিজলে আর কিই বা হবে? কাঁচের দরজাটা খুলে বাইরে এসে ওপর দিকে তাকালো, ছাই রঙা আকাশে কালো মেঘ টলমল করছে, মনে হল বৃষ্টি আসি আসি করছে। রাস্তায় নেমে ডানে বামে দেখে নিয়ে সোজা পশ্চিমমুখো হাটা দিল পাভেল।
ঘন্টাখানেক হাটার পরই বৃষ্টির প্রথম ছাট এসে গায়ে লাগলো। বেশ কিছুক্ষন নাক বরাবর বড় সড়কে, তারপর ওটা থেকে নেমে বা দিকের একটা ছোট রাস্তায় আরো কিছুটা সময় ধরে হাঁটছে পাভেল। নাহ, এবার ফিরতে হয়। ঘড়িতে দেখলো সাড়ে তিনটা। সন্ধ্যে হতে কমসে কম আরো একটা ঘন্টা। কিন্তু, ওদিকে আকাশের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে এসেছে। ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে, বৃষ্টির বেগও একটু একটু করে বাড়ছে। কেমন যেন নার্ভাস লাগতে লাগলো; এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এতোটা সাহস করা ঠিক হয়নি। পা একটু চালিয়ে এবার ক্যাম্পাসে ফিরতে হয়।
মিনিট বিশেক হয়তো হেটেছে, আকাশটা একবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। আর সেই কানে তালা লাগা আওয়াজ মেলাতে না মেলাতেই শুরু হয়ে গেলো তুমুল বৃষ্টি। হাটার গতি বাড়িয়ে পাভেল ছুটতে শুরু করে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন বৃষ্টি নামলো যে, দু’হাত দুরের কিছুও আর দেখা যাচ্ছে না। থেকে থেকে বিজলীর চমকে পথটা মাঝে মাঝে ঝলক দিয়ে দেখা দিয়েই আবার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। অবিশ্রাম বজ্রপাতের আওয়াজে কানে প্রায় তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। অন্ধের মতো কতক্ষন ধরে ছুটছিল মনে নেই, বারকয়েক আছাড়ও খেয়েছে। পড়ছে আর উঠে দৌড়াচ্ছে, এমনই সময় হঠাত ওর মনে হল পেছন থেকে নিকশ কালো অন্ধকার ভেদ করে একটা ক্ষীণ আলোর রশ্নি ওর পিঠটা ছুঁয়েই সামনে ছড়িয়ে পড়লো। ঘুরে দাঁড়ালো পাভেল। কই, কিছু তো নেই। উলটোদিকে ফিরে ফের যেই ছুটতে শুরু করবে, দেখলো, হাত দশেক দূরে মিটমিট করতে থাকা দুটো হেডলাইট বৃষ্টির ঘন চাদর চিরে বেরিয়ে আসছে। একমুহুর্ত না ভেবেই রাস্তার কিনারা ছেড়ে ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল পাভেল। ধীর গতিতে এগিয়ে আসা গাড়িটার দিকে দুই হাত তুলে পাগলের মত চিৎকার করে ওঠে, স্টপ! স্টপ! ঝড়ের শব্দে ওর চীৎকার চাপা পড়ে যাচ্ছে, তারপরও গাড়িটা নিঃশব্দে এগুতে এগুতে ওর সামনে এসে থেমে গেল। চিন্তা ভাবনা না করেই দরজার হ্যান্ডেল একটা হ্যাচকা টানে খুলে ফেলে ঝাপিয়ে পড়ে পেছনের সিটে পাভেল। ভিজে চুপসে যাওয়া শরীরটা ঠান্ডায় থরথর করে কাপছে। কোনমতে হাত বাড়িয়ে দরজাটা বন্ধ করতে না করতেই, গাড়িটা ফের একরকম ধীর গতিতে চলতে শুরু করলো। পাভেল নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ! কোন উত্তর না পেয়ে ও চোখ তুলে ড্রাইভার সিটের দিকে তাকালো। ওপাশের কাঁচটা নামানো, ড্যাসবোর্ডের টিমটিমে আলোতে যা দেখলো তাতে ওর সারা শরীরের রক্ত হীম হয়ে গেল, একি, স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে যে কেউ নেই, অথচ গাড়িটা চলছে। চলন্ত গাড়ির ভেতরে সে ছাড়া আর কী নেই। বাইরের তুমুল ঝড়ের আওয়াজ… গাড়ি ধীর গতিতে এগুচ্ছে, ইঞ্জিনেরও কোন শব্দ নেই। পাভেলের শরীরের কাপুনি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। কি করবে ভেবে মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। উইনশিল্ড পেরিয়ে ওর চোখ চলে গেলো বাইরে, হেডলাইটের ক্ষীণ আলো ঘন বৃষ্টিধারা পেরিয়ে কোথাও যাচ্ছে না, তবু বিজলীর ঝলসানিতে ওর মনে হল সামনে একটা হেয়ার পিন কার্ভ। রাস্তার পাশে গভীর ঢাল, গাড়ি যদি সময়মত মোড় না নেয় তাহলে সোজা প্রায় তিরিশ ফুট নিচে গড়িয়ে পড়বে। আতঙ্কে ওর মন অসাড় হয়ে এলো, মনে মনে নিজেকে শাপ শাপান্ত করতে করতে একবার জোরে চেচিয়ে উঠলো, আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে বাচতে দাও…তারপর কি মনে করে সারাজীবনে যত সুরা পড়েছে তার সব ক’টা একে একে জপতে শুরু করে দেয়। বন্ধ চোখ আবার যখন খুলল তখন পরিস্কার বুঝলো গাড়িটা একেবারে সেই চুলের কাটা বাকে এসে পড়েছে। ভয়ে চোখ ফের বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল, সেই মূহুর্তেই জানালার খোলা কাঁচের ওপাশ থেকে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো একটা কালো কুচকুচে হাত। ড্যাসবোর্ডের আবছ আলোয় দেখলো, বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে ওই হাত থেকে। গাড়ির ভেতরে ঢুকে সেই হাত আকড়ে ধরলো স্টিয়ারিংটাকে, আস্তে আস্তে গাড়িটা ডানদিকে মোড় নিতে শুরু করলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না পাভেল, বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে শুধু দেখলো, ড্রাইভারহীন গাড়ি, রাস্তার ঠিক মাঝ বরাবর রয়ে গিয়ে একদম স্বাভাবিক ভাবে ওই দুরন্ত বাকটা পেরিয়ে এলো। তারপর, সোজা রাস্তায় গাড়িটাকে ছেড়ে দিয়ে ওই অশরীরী হাত আবার যেমনি এসেছিল তেমনি মিলিয়ে গেলো বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে। পেছনের সীটে পাভেলের হৃদপিণ্ড যেন বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মুখ খুলে বিশাল হা করে আবার চীৎকার করতে চাইলো, কিন্তু একটুও আওয়াজ বেরুলো না ওখান দিয়ে, শরীরটাও একদম স্থবির, আতংকের যে সীমা পেরিয়ে গেলে মানুষের বোধশক্তি লোপ পায় পাভেল সেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।
যখন ওর জ্ঞান ফিরে এলো গাড় অন্ধকারের ওপারে দেখল জলমাখা একটা নিয়ন সাইনের আলো; শহরের প্রান্তে এসে পড়েছে, আলোটা মনে হয় কোন একটা বারের জানালা ঠিকরে বেরুচ্ছে। কি করে পারলো জানে না, শরীরের শেষ সবটুকে শক্তি একত্রিত করে পাভেল ভেতর থেকে গাড়ির দরজাটা খুলে ফেলল। ধীর গতির চলন্ত সেই গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে প্রথমে এক লাফে রাস্তার কিনারায়, তারপর পড়িমরি করে এক ছুটে সেই বারের দরজায়।
ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি ঝরার শব্দ নিয়ে বারের দরজা খুলে যেতেই সবাই ওদিকে ফিরে তাকায়। বাচাও! বাচাও উম্মাদের মত চিৎকার করতে করতে পাভেল প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে একজন উঠে এসে ওকে ধরে বসিয়ে দিল বারের কাছে একটা চেয়ারে। কি হয়েছে তোমার? প্রায় দমহীন অবস্থায় বারটেন্ডার গ্লাসে কি দিলো তা একবারও না দেখে একচুমুকে পানীয়টা শেষ করে ফেলল, তারপর একটু দম নিয়ে পাভেল হড়বড় করে এবার ওর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করল।
কয়েক মিনিট পর, ঝড়বৃষ্টির ঝাঁপটা সাথে নিয়ে বারের দরজাটা আবারো ধড়াম করে খুলে গেল। চৌকাঠ পেরিয়ে এবার এসে ভেতরে ঢুকল দু’জন লোক। ভেজা চুপসানো ওদের জামাকাপড়, সমস্ত গায়ে কাঁদার মাখামাখি, অবস্থা অনেকটা পাভেলের মতই। সবার উতসুক দৃষ্টি এবার ফেরে ওদের দিকে; কিন্তু ওরা কাউকে একটা কথাও বলল না। শুধু সারাটা ঘরের এমাথা থেকে ওমাথায় চোখ বুলিয়ে মনে হয় কি যেন খুজতে থাকল। পাভেলের ওপর দৃষ্টিটা এসে থমকে গেল। সামনের কালো লোকটা পেছনের সাদা লোকটাকে হিসহিস করে বললো, দ্যাখ জন, ওই যে, ওই বদমাশটা; দ্যাখ এখানে বসে কেমন আরামসে মাল সাটাচ্ছে! শালা! তেল ফুরিয়ে যাওয়ার পর আমরা যখন তিন মাইল রাস্তা এই তুমুল ঝড়ের ভেতরে গাড়িটাকে ঠেলে ঠেলে শহরে আনছি, এই হারামজাদাই তো এক ফাঁকে লাটসাহেবের মতো গাড়িতে ঢুকে বসেছিল।